পর্যটকদের আকর্ষণ সংরক্ষিত বনাঞ্চল

পর্যটকদের আকর্ষণ সংরক্ষিত বনাঞ্চল 
photo-12

কাজী সাঈদ ॥
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লিলাভূমি পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটা। দীর্ঘ ১৮ কিলোমিটার সমুদ্র সৈকত। সৈকতের কোল ঘেষে রয়েছে বিশাল বনাঞ্চল। পশ্চিম দিকে সুন্দর বনের পূর্বাংশ ফাতরার বন, লেম্বুর বন, নারিকেল বাগান, ঝাউবাগান, গঙ্গামতি ও কাউয়ার চরের সংরক্ষিত বনাঞ্চল অন্যতম। আগত পর্যটকরা কুয়াকাটায় বেড়াতে এসে আশেপাশের বিভিন্ন পর্যটন ষ্পটগুলো ঘুরে দেখেন। পাশাপাশি সমুদ্রের কোলঘেষা বনাঞ্চল ঘুরে ফিরে ছবি তুলেন। এক কথায় এসব বনগুলো দর্শনার্থীদের অন্যতম আকর্ষণ। কিন্তু প্রাকৃতিক রক্ষা কবজ দিনে দিনে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাব, স্থানীয় বনদস্যু, ভূমিদস্যু, বন কর্মকর্তাদের অর্থবাণিজ্য ও অবহেলার কারণে উজার হচ্ছে সংরক্ষিত বনাঞ্চল।

সম্প্রতি কুয়াকাটা সৈকতের গঙ্গামতি বিটের সংরক্ষিত বনাঞ্চালের শতাধীক কেওড়া গাছ পরিকল্পিতভাবে উজার করেছে প্রভাবশালীরা। প্রাকৃতিক রক্ষা কবজ এ সংরক্ষিত বনায়ণ দু’দফার ধ্বংস যজ্ঞের সাথে জড়িত রয়েছে খোদ বন কর্মকর্তারা। মালিকানা জমির গুরুত্ব বাড়াতে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের বিশাল আকৃতির ওই গাছগুলো কাটা হয়েছে বলে জানিয়েছে স্থানীয়রা। এ বিষয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলে তোলপাড় শুরু হয়। বন কর্তারা বন রক্ষা না করে চাকুরী বাঁচাতে তদবীরে নেমে পরেন। বনদস্যুদের সাথে বন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাসিক আর্থিক লেনদেন কোন ভাবেই বন্ধ হচ্ছে না। বড় ধরণের বন উজার হওয়ার ঘটনা ঘটলেই জনবল সংকট ও জীবনের নিরাপত্তার অজুহাতে বরাবরই পার পেয়ে যান তারা।

প্রকৃতির অপার দান সৌন্দর্যের সাথে যুক্ত হয়েছে বনপ্রেমী ফয়েজ মিয়ার নারিকেল বাগান। যার বদৌলতে সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটা আরো বাড়তি সাজে সজ্জিত হয়েছে। এ নারিকেল বাগানটির প্রতি ছিল দর্শনার্থীদের এক অন্যরকম আকর্ষণ। সুশীতল দক্ষিণা বাতাস পর্যটকদের মনে এনেছে আলাদা আমেজ। গাড়ি পার্কিং, পিকনিক স্পট, পর্যটকদের বিনোদন কেন্দ্র ছিল এ বাগানটি। কিন্তু কালের বিবর্তনে বাগানটি আজ বিলুপ্ত প্রায়। বৃক্ষপ্রেমি ফয়েজ মিয়ার শখের বাগানটির অবশিষ্টাংশ আজ অরক্ষিত হয়ে পড়েছে।

১৯৬০ সালে বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেষা ১৯৭ একর সরকারী জমি ৯৯ বছরের লিজ নিয়ে বাগানটি করেছিলেন ফয়েজ মিয়া। “ফার্মস এন্ড ফার্মস” নামকরণ করেছেন। শুধু নারিকেল গাছ, এমন নয় অন্যান্য জাতের গাছও আছে। বাগানের মধ্যে পেয়ার, কেজু বাদাম, লেবু, কুল, গর্জন বাগানসহ বিভিন্ন জাতের ফলজ ও ঔষধি গাছ ছিল। নারিকেল গাছ পরিমানে বেশী ছিল বলে নারিকেল বাগান নামে পরিচিতি পেয়েছে।

সকাল সন্ধ্যা নানা জাতের পাখির কলরব মুখোরিত থাকত বাগানটি। গহিন বনে প্রবেশ করতে বন্য হিংস্য প্রাণী ও অজগরের ভয় ছিল। জোছনা রাতে গাছে গাছে বানরের লাফালাফি, শেয়ালের ডাকাডাকি আর লুকোচুরি, শুকুরের দূরহ দাঁত দিয়ে মাটির ভিতরের কেঁচো ধরে ভোজনের দৃশ্য এখন আর নেই। এসব অতিত হয়ে গেছে। এ অঞ্চলের বেঁচে থাকা বৃদ্ধ মানুষগুলো দেখছেন কল্পনায়। বর্তমান প্রজন্মের কাছে রূপ কথার গল্প হয়ে গেছে।

এ ব্যাপারে কথা হয় ‘ফার্মস এন্ড ফার্মস’ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক রেখা তারিক’র সাথে। তিনি বললেন, ১৯৬০ সালে আমার শ্বশুর মরহুম ফয়েজ উদ্দিন মিয়া ১৯৭ একর সরকারী জমি ৯৯ বছরের লিজ নিয়ে সখের বাগানটি করেছিলেন। সেই সময় সরকারী কোষাগারে ৬৫ হাজার টাকা রাজস্ব দিয়েছেন। বন জঙ্গল পরিস্কার করে বাগান উপযোগী করতে ৮০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। সর্বপরি বিভিন্ন জাতের গাছ রোপন করে বাগান করতে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করেছেন তিনি। বরিশাল শহরের ৫ একর জমি বিক্রি করে বাগানটি করেছিলেন আমার শ্রদ্ধাভাজন শ্বশুর ফয়েজ উদ্দিন মিয়া। হঠাৎ করে তিনি মারা গেলে আমার স্বামী মরহুম আবু তারিক ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব নিয়ে রক্ষণা-বেক্ষণ করতেন।

তিনি আরো বলেন, ২০০১ সাল থেকে বাগানের লিজ নিয়ে শুরু হয় টালবাহানা। এরপর থেকে বাগানটি হাত বদলের চেষ্টায় লিপ্ত হয় একটি প্রভাবশালী মহল। নিরুপায় হয়ে ২০০৭ সালে আমরা সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করি। মামলা চলমান অবস্থায় ২০০৯ সালে আমার স্বামী আবু তারিক মারা যান। আমি ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব নিয়ে মামলা পরিচালনা করি। সর্বশেষ হাইকোর্ট থেকে রায় আসে আমাদের পক্ষে। আমি বাগানের বুঝ পাওয়ার জন্য রায়ের কপি নিয়ে জেলা প্রশাসকের নিকট যাই। তিনি আমাকে জমির বাগানের বুঝ না দিয়ে উল্টো আপীল করেন। আপীল এখনও চলমান আছে।

মহিপুর ভূমি অফিস বলছে ভিন্ন কথা। মামলা চলমান অবস্থায় প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র উপস্থাপন করতে পারেনি ‘ফার্মস এন্ড ফার্মস’ কর্তৃপক্ষ। ১৯৬০ সালে প্রায় ২০০ একর জমি লিজ দেয়ার কোন বিধান ছিল না। এজন্যই সরকারী জমি সরকারের নিয়ন্ত্রনে নেয়া হয়েছে। তবে এখনও মামলা চলমান আছে।

এ বিষয়ে ‘ফার্মস এন্ড ফার্মস’ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক রেখা তারিক বলেন, ‘আমার শ্বশুর লিজ নেয়ার সময় যথানিয়মে নিয়েছিলেন। কিন্তু আমরা অনেক কাগজ পত্র হারিয়ে ফেলেছি। আমার শ্বশুর বনায়ন করার উদ্দেশ্যে মহতি উদ্যোগ নিয়েছিলেন। অন্য আর কোন উদ্দেশ্য তাঁর ছিল না বা আমারও নেই।

সরেজমিনে জানা গেছে, গত ২০ বছর যাবৎ অব্যাহত বালুক্ষয় হচ্ছে। বালুক্ষয় রোধের চেষ্টা করেনি কোন সরকার। তারপরেও ধীরে ধীরে সমুদ্রগর্ভে বিলিন হতে থাকে বাগানটি। কিন্তু বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনে প্রভাবে জোয়ারের পানি অস্বভাবিক বৃদ্ধির পায়। ফলে প্রচন্ড ঢেউয়ের ঝাপটায় বালুক্ষয়ে ছোট হচ্ছে সাগরকন্যা কুয়াকাটার মানচিত্র। রাতারাতি পাল্টে যাচ্ছে তীরঘেষা সংরক্ষিত বনাঞ্চলের চিত্র। এভাবে অব্যাহত বালুক্ষয় হতে থাকলে আগামী দুই-তিন বছরে মুছে যাবে ফয়েজ মিয়ার বাগানের নাম ঠিকানা। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম ভূমি অফিসের ম্যাপে নদীগর্ভে বিলিন হয়ে গেছে লেখা দেখতে পাবে। আর লোকমুখে গল্প শুনবে এমনটাই বললেন এ অঞ্চলের বৃদ্ধজনরা। 

এতকিছুর পরেও এখনও যতটুকু বাগান আছে, তা রক্ষণা-বেক্ষণের অভাবে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। রাতের আধাঁরে বনখেকোরা কেটে নিচ্ছে বড় বড় গাছ। এভাবে অরক্ষিত থাকলে এবং বালুক্ষয় রোধ করা না হলে বাগান থাকবে না। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে বাগানের গল্প মনে হবে রূপ কথার গল্পের মতো। ‘২০১৬ সাল পর্যটনবর্ষ সফল করতে হলে আগত পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ ফয়েজ মিয়ার নারিকেল বাগানটি সংরক্ষণ করতে হবে। পাশাপাশি দেশের একটি ব্যাপক সম্ভবনাময় পর্যটন কেন্দ্র রক্ষা করতে হলে বালুক্ষয় রোধের উদ্যোগ নিতে হবে রাষ্ট বা সরকারকে’।

কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত ঘুরে দেখা গেছে, স্যাঁতস্যেঁতে বালুর সৈকতের বিশাল এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য গাছের মূল। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রচন্ড ঢেউয়ের ঝাপটায় গাছের মূল থেকে বালু সরে উপচে পরা গাছ রাতের আধাঁরে কেটে নিয়ে গেছে উপকূলের লোকজন। আর নিচের অংশ সৈকতে পরে আছে। এছাড়াও বনাঞ্চলের পাশে এখনও অসংখ্য গাছ উপচে পরে আছে। ফলে জোয়ারের সময় কুয়াকাটা আগত দর্শনার্থীদের সমুদ্র স্নান করতে মারাত্মক সমস্যা হচ্ছে। এ সমস্যা মোকাবেলা করেই পর্যটকদের স্নান করতে হচ্ছে। কারণ এগুলো কেউ দেখছে না। যাদের দেখার কথা তাদের চোখে কালো চশমা। কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন ও রক্ষণা-বেক্ষণের জন্য ‘বীচ ম্যানেজমেন্ট কমিটি’ নামে আছে কাজে নেই। তারা ৭৩ কিলোমিটার পটুয়াখালী জেলা শহরে থাকে। অন্যের দ্বারা টেবিল চেয়ারের ধূলা মুছে যাদের অফিস করার অভ্যাস তারা কিভাবে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত পরিস্কার রাখবেন এমন প্রশ্ন এখন সকলের মুখে মুখে।

এদিকে গোটা সৈকত এলাকায় অসংখ্য গাছ মূলের মাটি হারিয়ে নিয়তির নিকট প্রাণ ভিক্ষার মিনতি করছে। কিন্তু বৃক্ষের এ মিনতি শুনছে না রাক্ষুসে সমুদ্র। প্রতি জোয়ারের স্রোতে ঢেউয়ের আঘাতে বালুতে লুটিয়ে পরছে বড় বড় এক একটি গাছ। উপচে পরা কিছু গাছ সমুদ্রে স্রোতে পাড়ি দিচ্ছে অজানার উদ্দেশ্যে। আর সৈকতে থাকা গাছগুলো রাতের আধাঁরে নিয়ে যাচ্ছে যাদের নেয়ার কথা তারাই। যার ফলে উপকূলের সংরক্ষিত বনাঞ্চল অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। ধীরে ধীরে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে কালেরসাক্ষী হয়ে এসে দাঁড়িয়েছে, ফয়েজ মিয়ার ‘ফার্মস এন্ড ফার্মস’ ও বন বিভাগের সংরক্ষিত বনাঞ্চল। এভাবে চলতে থাকলে উপকূলীয় বনাঞ্চল কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? এমন প্রশ্ন অনেকেরই।

এ বিষয়ে ফয়েজ মিয়ার বাগানের বাসিন্দা আব্দুস সাত্তার বলেন, আমরা সমুদ্র পাড়ে বাস করি। ঝড় বন্যা আমাদের নিত্যদিনে সঙ্গি। সাগর পাড়ে গাছপালা থাকায় বন্যার সময় বাতাসের চাপ কম লাগে। গাছপালা না থাকলে বেড়িবাঁধের বাহিরে বসবাস করা যাবে না। দমকা বাতাসে বাড়ি ঘর নিয়ে যাবে।

সমুদ্র পাড়ের বনাঞ্চল রক্ষার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যথাযথ উদ্যোগ নিবেন। বৃক্ষপ্রেমী ফয়েজ মিয়ার বাগনের অবশিষ্টাংশ সংরক্ষণ করবেন এমন দাবি উপকূলবাসীর। এক্ষেত্রে বনরক্ষিদের আরো বেশী দায়িত্বশীল হয়ে কাজ করতে হবে। পাশাপাশি সমুদ্র সৈকত রক্ষায় সরকারকে বালুক্ষয় রোধে জোড়ালো উদ্যোগ নিতে হবে।

এ ব্যাপারে পটুয়াখালী বিভাগীয় বন কর্মকর্তা অজিত কুমার রুদ্র জানান, ‘সংরক্ষিত বনাঞ্চলের গাছ কাটার খবর শুনলেই সংশ্লিষ্ট বিটের দায়িত্বে থাকা অফিসার মামলা করবেন। অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনিও জনবল সংকটের কথা উল্লেখ করেন। # # #

No comments

Powered by Blogger.