শিশুর কাঁধে অভাবের বোঝা
শিশুর কাঁধে অভাবের বোঝা
কাজী সাঈদ॥Photo001 |
হাসি-খুশি ও আনন্দ-উল্লাসে বেড়ে ওঠার কথা ওদের। ওদের থাকার কথা ছিলো স্কুল-মাদ্রাসায়। হাতে থাকবে বই, খাতা, কলম। ওদের কাঁধে থাকবে স্কুল ব্যাগ। শিক্ষার আলোতে আলোকিত হওয়ার স্বপ্ন দেখার কথা ছিলো ওদের। কিন্তু ওরা নদ-নদী, সমুদ্রে মাছ ধরায় ব্যস্ত। ওদের কাঁধেও সংসারের অভাব অনটনের বোঝা। ওরা দক্ষ জেলে থেকে দক্ষ মাঝি হওয়ার স্বপ্নে বিভোর। একটি নৌকা বা ট্রলারের নেতৃত্ব দেয়ার স্বপ্ন লালন করতে করতে সংসার জীবনে প্রবেশ করে। যুগ যুগ ধরে এ নিয়ম চলছে অবহেলিত জনপদে। অভাবি সংসারের বোঝা কাঁধে নিয়ে অন্ধকার গন্তব্যে হাঁটছে ওদের ভবিষ্যত জীবন। দারিদ্রের কষাঘাতে অনিশ্চয়তায় বিবর্ণ হয়ে ওঠে ওদের শৈশব। শিশুশ্রমের বেড়াজালে বন্দিজীবন কাটে শিশুদের। মোট কথা উপকূলের হাজারো শিশু সুখের শৈশব ছেড়ে কষ্টের কর্মজীবনে প্রবেশ করে।
উপকূলের শিশুরা কখনো সমুদ্রে নেটজাল টেনে বাগদা রেণু আহরণ করে, কখনো নিষিদ্ধ কারেন্টজাল টেনে ফাইশা, পোমা জাতীয় মাছ ধরে, কখনো মইয়্যা, ঝাকিজাল টেনে চিংড়ি মাছ ধরে, আবার কখনো ইলিশ আহরণে বড়দের সাথে সমান তালে কাজ করে আবার কেউ কেউ সস্তায় শ্রম বিক্রি করে। ওরা কখনো জেলে, কখনো কৃষক, কখনোবা কঠোর পরিশ্রমী দিনমজুর। মোটা দাগে বলা যায় যখন যে কাজ থাকে তখন সে কাজে ওরা শিশুশ্রম বিলিয়ে দেয়।
কুয়াকাটার উপকূলের অভাব অনটনের যাতাকলে নিষ্পেষিত হাজারো শিশুর জীবন। শিক্ষা যেখানে আমাবশ্যার চাঁদ। দু’বেলা দু’মুঠো খাবারের সন্ধানে নিয়তি যাদের ডাকে হাড়ভাঙা কর্মে। শিশু সুরক্ষার কথা ওরা জানে না, জানে না ওদের অভিভাবকরাও। শিশু অধিকারের বার্তা ওদের কাছে অর্থহীন। খেয়ে পরে বেঁচে থাকাই জীবনের সার কথা। শৈশব থেকেই শুরু হয় বিবর্ণ কর্মজীবনের অনিশ্চিত সূচনা। আবার জন্ম থেকেই অবহেলায় বেড়ে ওঠে কন্যা শিশুরা। অপরিণত বয়সেই বিয়ে হয়। বৃদ্ধি পায় বালক বালিকার সংসার। অতঃপর মাতৃত্বকালীন মৃত্যু ঝুঁকিতে থাকে অপরিনত বয়সের মায়েরা। পুষ্টিহীনতায় ভোগে হাজারো শিশু। উপকূলের প্রান্তিক জনপদে ঘুরলেই শিশুদের অন্তহীন দুর্দশার চিত্র চোখে পড়ে। পরিবর্তনের হাওয়া লাগেনি বঙ্গোপসাগর ঘেঁষা উপকূলের প্রান্তিক জনপদের পল্লীগুলোতে। বর্তমান আধুনিক যুগের সাথে তাল মিলিয়ে পরিবর্তনের দায়িত্ব এখন রাষ্ট্র বা সরকারকেই নিতে হবে এমন অভিমত বিশিষ্টজনদের।
গঙ্গামতির সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, যেখানে শিশুদের কাঁধে থাকার কথা স্কুল ব্যাগ, সেখানে কোমলমতি শিশুদের কাঁধে ওঠে সংসারের বোঝা। যে চোখে স্বপ্ন দেখার কথা উজ্জ্বল ভবিষতের, সেই চোখ নির্ঘুম রাত জাগে গভীর সমুদ্রে মৎস্য আহরণের প্রয়োজনে। নৌকা আর জাল নিয়ে ছুটতে হয় মৎস্য শিকারে। শুধু জেলে, কৃষক ও শ্রমিকই নয়-কর্মের সব ক্ষেত্রেই এদের সমান পদচারণা।
কুয়াকাটার গোটা উপকূল জুড়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধের ঢালে ও বাঁধের ভিতরে-বাহিরে বসবাসকারী জনগোষ্ঠির শিশু সন্তানরা এভাবেই বেড়ে ওঠে। পৃথিবীর আলোতে এসেই গন্তব্যহীন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে চলে ওরা। পূর্ব পুরুষদের পেশায় দক্ষতা অর্জনের স্বপ্নে ওরা বিভোর। অভাব অনটনের সাথে যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত জেলে পরিবারের অভিভাবকরা সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবার সময় পায় না। ছেলে মেয়েদের স্কুলে পাঠাতে অনেকটা আগ্রহ নেই দরিদ্র পিতা-মাতার।
সরেজমিনে পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার ধুলাসার ইউনিয়নের কাউয়ারচর, চরচাপলী, গঙ্গামতি, চরগঙ্গামতি, নতুনপাড়া, বড়হরপাড়া, মম্বিপাড়া এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, জেলেপাড়ার শিশুরা সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ভিতরের খালে জাল টেনে মাছ ধরছে। যখন জাল টেনে মাছ বেশি পাওয়া যায় তখন ওরা স্কুলে যায় না। মাছ যখন পাওয়া যায় না তখন স্কুলে যায়। জঙ্গলের ছোট ছোট খালে জাল টেনে মাছ ধরে বিক্রয় করে। তাতে যে টাকা পায় তা সংসারের প্রয়োজনে খরচ হয়।
চরগঙ্গামতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৩য় শ্রেণির ছাত্রী জান্নাতি। জান্নাতির সাথে যখন এ প্রতিনিধির কথা হয়, তখন তার মাথায় জালের বোঝা। জান্নাতি জানালো, স্কুলে না গিয়ে বাবার সাথে সমুদ্র তীরে কাজ করছে। তার বাবা আঃ জলিল পেশায় খুঁটা জালের জেলে। সমুদ্রে মাছ না পেয়ে জাল তুলে আনছেন তীরে। সেখান থেকে জান্নাতি জালের বোঝা মাথায় নিয়ে ফিরছে বাড়ির উদ্দেশ্যে।
চরচাপলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৩য় শ্রেণির ছাত্র সাইদুল ইসলাম জানালো, মাছ বিক্রয়ের টাকা দিয়ে তার বাবায় কিস্তি দেয়। তার বাবা জামাল হোসেন একজন জেলে। বাবায় যখন মাছ না পায় তখন সংসারে অভাব লাগে তা সাইদুলের অজানা নয়।
চরগঙ্গামতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আল-আমিন (৩য় শ্রেণি), জাহিদুল ইসলাম (২য় শ্রেণি), জিহাদ (৩য় শ্রেণি), সুমন (৩য় শ্রেণি)। এদের সকলের বাড়ি চরগঙ্গামতি (স্থানীয় নাম বাস্তবহারার চর)। ওরা সকলে সমুদ্রের তীরে পঁচা ইলিশ মাছ কুড়াচ্ছে। তুফানের ঝাপটায় জাল থেকে ছুটে আসে পঁচা ইলিশ। ওরা জানালো, পঁচা ইলিশ মাছ পেলে লবন দিয়ে স্থানীয় গদিতে বিক্রি করে। তাতে যে টাকা পায় তা নিজেদের প্রয়োজনে খরচ করে।
ওদের স্কুলে যাওয়া ও খেলাধুলায় ব্যস্ত থাকার কথা থাকলেও এখানকার চিত্র অনেকটা ভিন্ন। ওদের হাতে বই, খাতা, কলম থাকার পরিবর্তে থাকছে মাছ ধরার সামগ্রী। এ জনপদের অভিভাবকরা একদিকে অভাবের সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করছে, অপরদিকে তাদের মধ্যে সচেতনতার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। যার ফলে এখানকার শিশুরা শিক্ষা থেকে পিছিয়ে রয়েছে। এ জনপদের শিশুরা শিক্ষার আলোতে আলোকিত হবে-কি, হবে না তা অনিশ্চিত বাধার প্রাচীরে ঘেরা।
উপকূলের বিপন্ন জনপদের শিক্ষিত সমাজের কয়েকজনের সাথে আলাপ করলে তারা বলেন, ‘এ অঞ্চলে প্রয়োজনের তুলনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুবই কম। প্রান্তিক এ জনপদের অভিভাবকরাও অনেকটা অসচেতন। তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশিপাশি অভিভাবকদের সচেতনতার লক্ষ্যে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে এমন অভিমত তাদের।’
দেশের দক্ষিণাঞ্চলের এ প্রান্তিক জনপদের বসবাসকারী পরিবারগুলোর অভাব অনটনের বোঝা প্ররিবারের প্রধান, শিশু সন্তানের কাঁধেই নয়। এ বোঝা মায়েদেরও বহন করতে হচ্ছে। সংসারের গৃহস্থলির কাজের ফাঁকে মায়েরাও নেমে পরেন মাঠে-ঘাটে, নদী-খালে। তারা কাজ করছেন পুরুষের সমান সমান। জঙ্গলের গহিনের খালে এরা মাছ ধরছেন জাল টেনে। লোক লজ্জার ভয়কে জয় করেছেন অভাবের কারণে। স্বামীর সাথে খালে-বিলে, নদ-নদীতে, সমুদ্রে সৈকতে এ বিপন্ন এলাকার মায়েরা মাছ ধরছেন।
সরেজমিনে চরচাপলী গ্রামের এমনই কয়েকজন মায়ের সাথে দেখা হলো। সংরক্ষিত বনাঞ্চলের আঁকা-বাঁকা ছোট ছোট খালে চিংড়ি মাছ ধরছেন সালমা বেগম, মনোয়ারা বেগম ও আম্বিয়া খাতুন। হাতে ক্যামেরা দেখে অনেকটা লজ্জাই পেয়েছেন। তাই অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে মাছ ধরা বন্ধ রেখে পানির মধ্যেই বসে পরলেন। মুখ ঘুরিয়ে ছবি তুলতে রাজি হলেন না। তাদের সাথে কথা বলার আগ্রহ দেখে কথা বললেন শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে।
তিন সন্তানের জননী সালমা বেগম জানালেন, তার স্বামী খুঁটা জালের জেলে, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে মাছ পায় না। এনজিও থেকে ঋণ নেয়া আছে। কিস্তির জ্বালা আর সহ্য হয় না। তাই চিংড়ি মাছ ধরে স্থানীয় গদিতে বিক্রয় করে কিস্তির টাকা পরিশোধের জন্যই খালে নামা।
এ বিষয়ে কুয়াকাটা খানাবাদ ডিগ্রি কলেজের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আঃ রাজ্জাক খান বলেন, ‘দেশ উন্নত করতে হলে জাতীকে শিক্ষিত হতে হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষাখাতকে দুর্নীতিমুক্ত করার উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে। প্রতি অর্থবছরে জাতীয় বাজেট অধিবেশনে শিক্ষা মন্ত্রনালয়কে যে অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়, তা সঠিকভাবে বণ্টন করতে হবে। পাশাপাশি উপকূলীয় অঞ্চলকে নিয়ে আলাদাভাবে চিন্তা করতে হবে সরকার তথা রাষ্ট্রকে।
এ প্রসঙ্গে কুয়াকাটা প্রেসক্লাব সভাপতি ও সাগরকন্যা পত্রিকার সম্পাদক নাসির উদ্দিন বিপ্লব বলেন, উপকূলীয় অঞ্চলের শিশুদের মানসিক বিকাশে সরকারের পাশাপাশি শিশু সংগঠনগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।
No comments