গঙ্গামতির রাখাল (পর্ব-০১)

গঙ্গামতির রাখাল (পর্ব-০১)
Novel Picture
Novel Picture

র্ষার শেষ পর্যায়।
বঙ্গোপসাগরের উপকূল সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটার মাইল পাঁচেক পূর্ব দিকে গঙ্গামতির চর। গবাদি পশু চড়ার মৌশুম চলছে। চরের একটু উপড়ে সবুজ ঘাস আর খানিকটা উপড়ে বিস্তর বড়ো জঙ্গল। দিনের বেলা গবাদি পশু ঘাস লতা-পাতা খায়। সন্ধার সময় গঙ্গামতি চরের জঙ্গলের গহিন থেকে সাগরের সাথে মিলিত খালের মোহনায় যেখানে সূর্যোদয় দেখার জন্য দর্শনার্থীরা মিলিত হয়। তার একটু উপড়ে জেলে ঘাটে দাঁড়ালে দেখা যায় সাদা-কালো, লাল-ধূসর-র্ফারা, ছোট-বড়-মাঝারি অনেক গুলো গরু এবং অপর পাশে একটু ফারাকে একদল সাদা-কালো মহিষ। গরু-মহিষ গুলো সাগরের তরঙ্গে ভেঙ্গে আসা জলের একটু তফাতে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হয় পশুরা পশুসভা করছে মশার বিরুদ্ধে। সাগরের জল জোয়ারের বাড়তে আছে। পশু গুলো ধীরে ধীরে উপড়ে অর্থাৎ জঙ্গলের পার্শ্বে আসছে। রাত্রিকালে জঙ্গলে থাকলে মশার আক্রমন হতে রেহাই পাওয়া যাবে না তা অবুঝ গবাদি পশুর অজানা নয়। সাগরে  ভাটা লেগে প্রায় মাইল খানেকের মতো  শুকিয়ে গেছে। গরু-মহিষ সাগরের জলের কাছাকাছি স্যাঁতস্যাঁতে বালুতে বিশ্রাম নিচ্ছে। মশরা দক্ষিনা বায়ুর সাথে যুদ্ধ করে পশুর তনুতে কামড় দিয়ে রক্ত চোষন করার জন্য অগ্রসর হতে পারছে না। যখনই গঙ্গায় জোয়ার আসবে তখনই মশারা আনন্দ করবে। আর একটু পরে ওদের ক্ষুদ্র পেটে বৃহৎ জ্বালা নিবারনের খাদ্য নিকটে আসবে- তা ওরা জানে। জোয়ারের জলে সাগর যখন কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে যায় তখন পশু গুলো মশার কামড় হতে এড়াতে না পেরে জলের পাশে পাশে হাটতে থাকে। এভাবে সমস্ত রাত মশা আর গবাদি পশুর মধ্যে যুদ্ধ হয়। এক সময় পূর্ব অন্তরীক্ষে সূর্য গভীর জল ভেদ করে ধরণী সোনালী আলোতে প্রজ্জ্বলিত করল।

মনু আজ গরু-মহিষ চড়াতে গঙ্গামতির চরে ছন ভিটায় গেছে। মনু একা নয় আরও চার পাঁচ জন রাখাল আছে। গনি,ওসমান,আবুল ও রাছেল। ওদের সকলের বাড়ি গঙ্গামতি গ্রামে। গরু-মহিষ গুলো ওদের নিজেদের না। গঙ্গামতি গ্রামের মাইল তিনেক উজানে মিশ্রীপাড়া,ডংকুপাড়া, হোসেনপাড়া, লক্ষ্মীপাড়া, আছালতখাঁ পাড়া এবং গঙ্গামতি গ্রামের আশে-পাশের বিত্তবান লোকদের। রাখাল দল মাসিক মাহিনা হিসাবে গরু প্রতি দশ টাকা ও মহিষ প্রতি বিশ টাকা দরে রাখ্খালি রাখে। এক এক জনে পঞ্চাশ-ষাটটি গরু-মহিষ কেউ কেউ আবার তার চেয়েও বেশি প্রায় এক’শর মতো।
     
যেসব গ্রামের গরু-মহিষ রাখাল দল রাখ্খালি রাখে সেসব গ্রামের আমন ধান ফলানোর জমির হাল চাষ করার কাজ শেষ হয়ে গেছে। কৃষকরা দু-চারদিন বিশ্রাম নিয়ে ধানের চারা রোপন করা ক্ষেতে পাচ্চা বোন জন্ম নিয়েছে তা পরিস্কার করতে নামবে। আগাছা ফয়লা না করলে ভাল ফসল পাওয়া যাইবে না সকলের জানা। তারপর সার কিটনাশক ছিটাতে হবে- রিপকট, ম্যালাথিয়ান, ম্যালাডন ¯েপ্র করতে হবে, তা না হলে লাভের অংশ শূন্য এমনকি লোকসানও হতে পারে। কিন্তু বিলে মোটেও ফাঁকা জায়গা নাই গরু-মহিষ ঘাস খাইবে কোথায় ? দীর্ঘ দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করার পর শীর্ণ দেহের পশু গুলো শুধু কুটা ও পানি খেয়ে বাঁচতে পারবে না। গত বছর আমজেদ ব্যাপারীর দশটা গরুর দু’টি মারা গিয়েছিল আর একটির অবস্থাও ভাল ছিল না। দু-এক দিনের মধ্যে মারা যাবে সন্দেহ আমজেদ ব্যাপারীর। কিন্তু স্বয়ং বিধাতা বাঁচিয়ে রাখলো। আরো অনেক গুজব কর্ণপাত হয়েছিল আছালতখাঁ পাড়া গ্রামে বেশ কয়েকটা গরু মারা গিয়েছিল। ছোট বাছুর গুলো মায়ের স্তনের দুধ খাইতে না পেরে নিয়তীর সহিত আত্মহত্যা করেছিল। খড়-কুটা একটানা খাওয়ার জন্য মা গরুটার দুধ হয় নাই। একই গ্রামের খালেক প্যাদার খড়ের সেরা মহিষটা মারা গিয়েছিল। তাই এ বৎসর সকলেই একই সিন্ধান্তে উপনীত হয়েছে ফসলের জমি-জমা চাষ করার পর তাদের গবাদি পশু গুলো গঙ্গামতি রাখালদের কাছে রাখ্খালি দিবে।
এ বৎসরের নতুন রাখাল মনু “এতিমের মধ্যে সবচেয়ে বেশী এতিম, অসহায়র মধ্যে সবচেয়ে বেশী অসহায়”।

মনু যখন একবারে ছোট্র অবুজ নাবালক শিশু তখন ওর বাজান কাঞ্চন মিয়া, গঙ্গার জলে রূপালী ইলিশ মাছ ধরতে গিয়েছিল গভীর রাতে। সর্বনাশা প্রাণকাড়া সাগরের তরঙ্গ খেলায় ধমকা বাতাসে মাছ ধরার ছোট্র ডিঙ্গি নৌকাটা ডুবে তলিয়ে গিয়েছিল। দু’দিন পরে তার মৃত পচাঁ দেহ গঙ্গামতির মাইল তিনেক উজানে কাউয়ারচর ডোস এলাকায় পাওয়া গিয়েছিল।
কবে নাগাত মনুর বাবা কাঞ্চন মিয়া মারা গিয়েছে জিজ্ঞাসা করলে মনু বলে, “মোর বাজানের পরে মায় মরছে, মার কতা কইতে পারি না হেইয়্যার পর আবার বাজানের কতা ?”

একদিন সন্ধা বেলা সমস্ত পৃথিবী অন্ধকার হয়ে গেল তবে সূর্য ডোবে নাই। মেঘের আড়ালে লুকাইছে বৃষ্টি নামার সম্ভাবনা । কাঞ্চন মিয়ার রেখে যাওয়া এক জোড়া কালো রংয়ের ছাগল বাড়ীর সামনে বেড়িবাঁধের পরে জঙ্গলের পার্শ্বে বাঁধা ছিল। মনুর মা শরভানু আনতে গিয়েছিল। কিন্তু কোথা থেকে হঠাৎ ধমকা বাতাস এসে মুহূর্তের মধ্যে পুরো গঙ্গামতি গ্রামের রাখালপাড়া ওলোট-পালোট করে দিয়েছে। ছাগল জোড়া লইয়া বাড়ী ফেরার পথে ঝড়ো বাতাসে বিস্তর বড়ো একটা কেওড়া গাছ মডর মডর করে ভেঙ্গে শরভানুকে চাপা দিল। শরভানু জীবিত অবস্থায় আবাসনে ফিরতে পারে নাই, ফিরেছিল প্রাণহীন শুন্য দেহটা নিয়ে। তখন মনুর বয়স ছিল মাত্র ছয় বছর আর ছোট বোন ময়না আড়াই বছরের কন্যা।
প্রকৃতির নির্মম পরিহাসের কারনে পিতামাতার আদর স্নেহ হতে বঞ্চিত মনু ছোট বোন ময়নারে নিয়ে আপন চাচা চাঁনমিয়ার সংসারে থাকে। চাঁনমিয়া নিজের সন্তানের মতো ভালবাসে, স্নেহ করে। কিন্তু চাঁনমিয়ার বৌ ঝামেলা বিবি বাপ-মা মরা এতিম মনু ময়নারে নিজের সংসারে রাখাটা সহ্য করতে পারে না, ঝামেলা মনে করে। চাঁনমিয়ার ডরে আননে কিছুই বলতে সাহস পায় না শুধু গোমরাইয়া গোমরাইয়া মরে। মাঝে মধ্যে চাঁনমিয়া চাপলীর হাট থ্যাইকা পাঁচ-দশ টাকার চানাচুর খরিত করে আনলে ঝামেলা বিবি লুকাইয়া লুকাইয়া নিজের গর্ভের দুই পোলা মজু ও সাজুরে খাওয়ায়। মনু একদিন চাচা চাঁনমিয়ার সহিত বেন্দিজাল পেতে ফিরে দেখতে পাইল চাচাতো ভাই সাজু উঠানে পিঁড়িতে বসে পড়নের কাপড়ের টোবরে চানাচুর আর মুড়ি খাইতেছে। মনুরে দেখে সাজু টোবর চেপে মুখ বন্ধ করে রাখে। মনু বুঝতে পারে নাই তা নয়। সেকারনে মনু চালাকি করে বলে, “সাজু চাচিমা গেল কই”।
সাজু বলে, “মায় পুহির পারে পানি আনতে গেছে”।
কথাটা বলার সাথে সাথে সাজুর মুখের ভিতরে লুকানো থাকা দু’চারটা মুড়ি বাহির হয়ে স্যাঁতেস্যাঁতে বালুতে পরে গেল।
মনু বলে, “সাজু মুড়ি পাইলি কই ? মোরে কয়টা দেতো। ”
সাজু বলে, “ভাইয়া বাজান দোকান থ্যাইয়া আনছিল।”
সাজু আরো বলে, “মায় তোমারে দেহাইতে মানা হরছে”
এই বলিয়া ছোট্র হাতের এক মুঠো মুড়ি টোবর হতে বের করে মনুর হাতে দিল। মনু চলে গেল ঘরের মধ্যে দাওয়ায় ঝুলানো ছিড়া কাপড়টা লইয়া পুকুর পাড়ে নাইতে নামিল।
চানঁমিয়া বাড়ীতে ফিরে আসলে মনু বলে, “ চাচ মুই তোমাগো লগে আর থাকমু না। মোর বাজানের পোতায় একটা কুড়িয়া উঠাইয়া দেও। মুই ময়নারে লইয়া হ্যাইয়ানে থাকমু”।
চাঁনমিয়া আশ্চার্য হয়ে গেল। চোখে জল ছল ছল অবস্থায় বলে,
“ ক্যান মনু ক্যান, বাপরে তরে ক্যাডা কি কইছে”।
মনু ছোট্র হলেও বোকা না। হিতাহিত জ্ঞান বলতে কিছু একটা আছে। আসল কথা বললে চাচা ও চাচিমার মধ্যে ঝগড়া লেগে  যাবে। চাঁনমিয়া মনুরে কত বেশী ভালবাসে, স্নেহ করে তা মনু জানে।
“ চাচা কেহ কিছু কয় নাই, বাজানের পোতায় থাকতে মন চায় তাই ”
চাঁনমিয়া বলে, “বাপরে তুই আর একটু বড় হইয়া লয় হ্যাইয়ার পর থাহিস, তুই খাবি কি”?
“ ক্যান চাচা - মুই জঙ্গলের দাউর,ঠাল ঠোল কাইটা আডা বাইনন্দা মিশ্রিপাড়া যামু (রাখাইন উপজাতি) ভার্মিজের বাড়ী বেচমু। হ্যাইয়ার পর চাউল, ডাল কিনন্যা রান্দোন কইরর‌্যা ময়নারে লইয়্যা খামু”।

চাঁনমিয়ার বুঝতে বাকি নাই যে মনুরে কেহ কিছু একটা কইছে। চোখে রক্ত তুলে ঝামেলা বেগমের দিকে চাহিয়া বলিল, “ মনু ঠিক আছে কাইল থ্যাইকা জঙ্গলে কাঠ কুডা কাটতে যামু। হঠাৎ চাঁনমিয়া চুপ হয়ে গেল। একটা কারন আছে জঙ্গলে কাঠ-কুডা সব আছে, ছাউনীর জন্য কিছু নাই। নাড়া নাই, ক্ষেতে ছন নাই, গোল পাতা নাই। গোল পাতা যা ছিল তা মানসে লইয়া গেছে।
মনু বলে, “ চাচা ক্যান এ্যাতাল পাতা আছে না ”
রাখাল পাড়ার দক্ষিন কান্দায় রুস্তুম প্যাদার চালের ছাউনী হ্যাতাল পাতার -জলও পরে না। চাঁনমিয়া সায় দিয়ে বলে,
 “হ ব্যাডা তর বুদ্ধি কামে লাগবে আনে”
মনু বলে, “চাচা জঙ্গোলে এ্যাতাল পাতা, কাঠ কুডা কাডার আগে ফরেষ্টারের কাছে কইতে অবে না”
চাঁনমিয়া বলে, “ না ব্যাডা কইতে অবে না মোরা কি কাইটা বেচমু, ঘর উডামু জঙ্গল ছাড়া পামু কই”
এদিকে ঝামেলা বিবি একটু স্বস্তি অনুভব করল। পরের পোলা নিজের সংসার থেকে চলে যাচ্ছে। ঝামেলা বিবি খুশি হয়ে নিজের পোলা, দেবরের পোলা, স্বামী চাঁনমিয়ার জন্য ভাত বারিয়া ডাক দিল। ঝামেলা বিবি টিনের থালায় ভাত বারিয়া বসেছিল। সকলে একসাথে খেজুর পাতার মাধুরে বসে আধাপেডি ভাত খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল আর চাঁনমিয়া নৌকা লইয়া বেন্দিজালের মাছ আনতে গেছে।

আজ জালের শেষ প্রান্তে টোনে কি যানো লাফা লাফি করছে। কালির মতো অন্ধকার রাত নিজের শরীর দেখা যায় না। খালের অন্য জেলেরা জালের মাছ লইয়া ফিরে গেছে।  চাঁনমিয়া ছাড়া খালের মধ্যে আর কোন জেলে নাই। একটা টুকরি কোথাও জ্বলছে না। চাঁনমিয়া ভয়তে জালের শেষ প্রান্তে (জেলেদের ভাষায় টোন) যাচ্ছে না। একাকি কোন উপায় খুঁজে  না পেয়ে বুকের মধ্যে সাহস সঞ্চায় করে ধীরে ধীরে জাল নৌকায় টানিতে আরাম্ভ করিল। সব জাল নৌকায় উঠাতেই দেখতে পেল বিস্তর বড়ো একটা কোড়াল মাছ। কেজি সাতেক ওজন হবে চাঁনমিয়ার অনুমান। ছোট মাছের মধ্যে চিংড়ি মাছ। কাটাযুক্ত ফাহা ও চেউয়া মাছ পাইল অনেক। চাঁনমিয়া মাছ গুলো নৌকার পাটাতনের ফাঁকে দু’খানা তক্তা ফাঁক করে খোলের মধ্যে লইয়া মনের আনন্দে বৈঠা মেরে ঘাটে চলে আসল। ঘাটে ফিরে খোলের মাছ গুলো জাজঁড়া ঝুড়িতে তুলে ঘরের দরজায় এসে খুশি মনে ডাক দিলো-
“ ঝামেলা.........ও ঝামেলা যলদি টুকরি জ্বালা বড়ো মাছ পাইছি”
ঝামেলা বিবি,“ কি হইলো গো তোমার”

এক হাতে ল্যাম্প অন্য হাতে পিঁড়ি লইয়া মাছের ডালার পার্শ্বে পিঁড়িটা রেখে বসে ছোট মাছ গুলো আবর্জনা হতে পৃথক করতে আরাম্ভ করল। ঝামেলা বিবি স্বামীর কাছে সোহাগ কন্ঠে বলে,
“ওগো কোড়াল মাছটার দাম কত অবে”
চাঁনমিয়া বলে, “যানে ক্যাডা কত অইবে ? ব্যানে কুয়াকাটা লইয়া যামু ভাল দাম পামু আনে”স্বামী-স্ত্রী মাছ গুলো বেছে আবর্জনা হতে পৃথক করে ভিন্ন ভিন্ন পাত্রে রেখে খেড়ের  ঘরের খেজুর পাতার বিছানায় ছিড়া পাতলা কাঁথা শরীরে জড়িয়ে শুয়ে পড়ল। শুয়ে শুয়ে চাঁনমিয়া ভাবে বন্দরে মাছটা বিক্রি করে পাঁচ টাকার তামাক আর ঝামেলার জন্য একটা শাড়ী কিনবে। অনেক দিন হয়েছে ঝামেলার পড়নে ছিড়া কাপড়। চিন্তা করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল তা কে জানে ?
সাঁঝের বেলা ঘুম থেকে সবার আগে উঠল চাঁনমিয়া। নামাজ কালাম শেষে দেখতে পেল গামলার কোড়াল মাছটা নাই। “ঝামেলা ....... ও ঝামেলা সব শেষ অইয়া গেছে।” ঝামেলা বিবি চোখের পাতা খুলে বলে, “ কি শ্যাষ অইয়া গেছে।”
                         “কোড়াল মাছটা কই?”
ঝামেলা বিবি বলে, “ ক্যান এইহানেই তো আছিল।”
চাঁনমিয়া কহিল, ‘ মাছটা কিতে যানো লইয়া গেছে।’
    ধারনা করা হলো ‘পাতিশৃগালে নিয়ে গেছে।’
চাঁনমিয়া হাটু বাঁকা করে বসে কহিল,
“হালার পাতি হাল মোর হারা রাইতের কষ্টের মাছটা লইয়া গেলি ! তোর মরনও অয়না।”
ঝামেলা বলে, “ তোমারে কত বার কইছি ভাল কইর‌্যা বেড়া দাও। তুমি মোর কথাই হোনলা না। এ্যাহন মোর ভাল অইছে।”
চাঁন মিয়া গর্জন করে বলে, “ঝামেলা ফিরর‌্যা কথা কইলে তোরে মাইয়াহালামু কইলাম।”
ঝামেলা বিবি আর কোন কথা কইবার সাহস পায় নাই। চাঁনমিয়া লম্বা লালচে চুলের মাথাটা নিচু করে চুপ চাপ বসে রইল। দেখলে মনে হয়- মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর প্রাগৈতিহাসিক উপন্যাসের নায়ক ভিক্ষু।
মনু  ঘুম থেকে উঠে চাঁনমিয়ার সন্নিবেষ্টিত হয়ে বলে, “চাচা জঙ্গোলে যাইবা না।”
চাঁনমিয়া বলে, ‘ না বাজান তুই পারবি না দাউর বেইচা খাইতে।’
মনু বলে, ‘চাচা মুইও তো চিন্তায় আছিলাম। অহন একটা বুদ্ধি পাইয়া গেছি।’
মনু কি বুদ্ধি পেয়েছে চাচা চাঁনমিয়া জানতে চাইলে মনু বলে,
“গনি, ওসমান,আবুল ও রাছেলের মতো গরু-মহিষ রাখ্খালি রাখমু।”
চাঁনমিয়া বলে,“ তুই পারবি বাজান ?”
মনু বলে, “পারমু না ক্যান ওরা পারলে মুইও পারমু ?”
চাঁনমিয়া বলে, “ তাইলে তো আর কোন চিন্তা নাই।

তখন থেকে এতিম মনু গরু-মহিষের রাখাল হয়ে গেল। রাখাল খাতায় নাম লিখল “মনু রাখাল”। মনু আধা পেডি পান্তা ভাত খেয়ে দা-কুড়াল নিয়ে জঙ্গলে গিয়ে খান দশেক কেওয়া গাছের খুঁটি, কুড়ি খানেক হ্যাতাল গাছ, লম্বা লম্বা কুড়ি দুই গেওড়া কচাঁ এবং এক আডা বলই গাছের ডোক কেটে আটা বেঁেধ একাধিক বার মাথায় করে আনল। দু’দিনের মধ্যে ছোট্র একটা কুটির উঠাইল। হ্যাতাল গাছের পাতা কেটে ছাউনী এবং বেড়া দিয়ে দিল। মনু ছোট বোন ময়নারে নিয়ে মা-বাবার রেখে যাওয়া পুরানো হাড়ি -পাতিল ঝামেলা বিবির কাছ থেকে এনে একদিনের চাউল ডাল কর্জ করে ভাই বোনের সংসার শুরু করল। পরের দিন সকাল বেলা বাড়ীর পাশের লিটু, আব্বাস, ছলেমান, বাবুল, সেন্টু ও মাদবের সাথে একটা ‘ দা নিয়ে জঙ্গলে লাকড়ি কাটতে চলে গেল।

ওরা সকলে আধা বেলা লাকড়ি কেটে আডা বাধঁতে আরাম্ভ করল। দড়ি বা রশির প্রয়োজন হয় নাই। কালিয়া লতার গাছের সাথে প্যাচ ছাড়িয়ে আডা বাধল। লাকড়ি কম হয় নাই চার আডা হয়েছে। মনুর বন্ধুরা কইল,
“ মোরা সবাই ল  মামাকলা (শীতাফল) খাইয়া লই।”
সকলে চলে গেল শীতাফল গিলতে একটু তফাতে হাড়কুচি গাছের উপর লতা বিশিষ্ট গাছে অবিকল কামড়াঙ্গা ফলের মতো আসলে কামড়াঙ্গা না । তার চেয়ে আকারে ছোট ফল মামাকলা (শীতাফল)। অনেকে আবার জামাইকলিও বলে। কিছু সময় শীতাফল গিলে ধীরে ধীরে লাকড়ির আডা গুলো মাথায় করে রাখাল পাড়ায় আনতে আরাম্ভ করল। সবার আগে মনুর আনা হয়েছে। কারন মনু নতুন কাঠুরিয়া সবার চেয়ে দুই আডা কম কেটেছে।

আসরের নামাজের সামান্য আগে ছয়জন শিশু কাঠুরিয়া লাকড়ির আটা মাথায় নিয়ে চলে গেল মিশ্রিপাড়া গ্রামের উপজাতি রাখাইন পাড়ায় বিক্রি করতে। বিশ টাকা বিক্রি করে দু’কেজি চাউল কিনে বাড়ী চলে আসল। মনু ওদের চেয়ে পাঁচ টাকা কম বিক্রি করেছে। কারন ওদের চেয়ে মনুর আটাটা ছোট ছিল। যদিও মনু আজই অনেক কষ্ট হয়েছে পথ তো তফাৎ কম না গঙ্গামতির রাখাল পাড়া হতে মিশ্রীপাড়া সাড়ে তিন মাইল তফাৎ। পহেলা দিন তো সমস্ত শরীর ব্যাথা হয়ে গেছে বটে-তবুও মনুর কষ্ট নাই কারন আজ পহেলা নিজের উপার্জনের মাহিনা হাতে পেয়েছে।

সন্ধায় বাড়িতে এসে কাদা-বালু মিশানো ঘরের মেঝেতে পুরানো ছিড়া খেজুর পাতার ওগলায় ছোট বোন ময়নারে লয়ে কাঁথা মুড়ো দিয়ে ঘুমিয়ে পরল। সকাল বেলা ঘুম থেকে জেগে চাঁনমিয়া আপন ভাইর পোলা মনুরে লয়ে আছালত খাঁ পাড়া চলে গেল। চাঁনমিয়ার সাথে ঐ গ্রামের সকলের মোটামুটি ভাল আলাপ আছে। তাই ওনার  আপন ভাইপোল্যার কাছে গরু মহিষ রাখতে দিতে কেউ আপত্তি করে নাই। তাছাড়া তাদের গরু-মহিষ চাঁনমিয়ার তত্ত্ববাধনে থাকবে। আছালতপাড়ার বিত্তবান লোক খালেক প্যাদার বারোটি মহিষ এবং পনেরটি গরু আছে। প্যাদা বলে, “চাঁন ভাই গত বার মোর একটা বড়ো মহিষ মইর‌্যা গ্যাছিল। এবার চিন্তা করছি গঙ্গামতির চরে রাখ্খালী দিমু ক্যাড্ডে দিমু ভাবতেছিলাম। তুমি যহন আইয়্যা পরছ এ্যাহন মোর আর কোন চিন্তা নাই।”

আমজেদ ব্যাপারী, খালেক ফরাজী, সত্তার মাষ্টার, শাহেদ আলী, রশিদ কাজী মোট মাট একান্নটা গরু ও উনিশটা মহিষ হয়েছে মনুর।
 দু’চার দিনের মধ্যে গরু মহিষ চাঁনমিয়ার বাড়ীতে পৌছে দিল। মনু চাচাতো ভাই সাজু মজু ও চাঁনমিয়ার সহযোগীতায় গরু মহিষ বাড়ী হতে মাইল খানেক দক্ষিনে গভীর জঙ্গোল। জঙ্গলের মাঝে মাঝারি একটা খাল। খালের ওপারে বিস্তর বড়ো “গঙ্গামতির চর”। কেউ কেউ আবার পাতিশিগালের চরও বলে থাকে। কারন গঙ্গামতির চরে অগুনিত পাতিশৃগাল বসবাস করে। তাই এখানকার লোকজন পাতিশৃগালের চর বলে। গঙ্গামতি চরের একটু তফাতে বাস্তহারা গ্রাম। তার পুবে কাউয়ার চর। তবে কাউয়ার চরে গরু-মহিষ রাখতে যাবে না ওরা।
পহেলা দিন গ্রাম্য গরু-মহিষ জঙ্গলে ডুকে গাছের ফাঁকে ফাঁকে দৌড়াদৌড়ি আরাম্ভ করে দিল হাড়কুচি পাতার কাটায় শরীর চিরে চিরে লাল রক্ত জড়ছে। চার পাঁচ জন মিলে বহু কষ্টে জঙ্গল ভেদ করে খাল পার হয়ে গঙ্গামতির চরে পৌছে গেল। গরু-মহিষ গুলো উঁচু বালুর স্তুপের উপর জন্মানো লতার (স্থানীয় ভাষায় গোস্তলতা বলে) পাতা গিলতে শুরু করল। লতার সাথে পাতা,পাতার মাঝখানে ফাঁকা শরীরের কোন অংশ কেটে গেলে পাতা পিশে কাটা স্থানে বেধে দিলে তাড়াতাড়ি সুফল পাওয়া যায়। তাই এখানকার লোকজন গোস্তলতা বলে।

সন্ধাকালে গরু মহিষ গুলো সাগরের মোহনা খালের গোড়ায় মৌফল গাছের তলায় ছোট ছোট খুঁটা পুতে হাত পাঁচেক রশি দিয়ে কোনটার শিং এর সাথে, কোনটার গলায় এবং মুখের একটু উপরে নাগাই দিয়ে বেঁধে রাখল। কিন্তু গনি,আবুল,ওসমান ও রাছেলের গরু-মহিষ বাঁধা লাগে নাই। মনুর গরু-মহিষ গুলো চর অঞ্চলে নতুন কোথাও যেতে পারে তাতে কোন সন্দেহ নাই। ভাল করে গরু-মহিষ গুলো আটক করে সকলে রাখাল পাড়ায় চলে আসল। মনু ময়নারে ডাক দিয়ে বলে, “ময়না ........ এ ময়না বোইন মোর গেলি কই।”
মনুর বাড়ী ফিরতে বিলম্ব হওয়ার জন্য এতিম ময়না চাঁরমিয়ার ঘরে ঝামেলা বিবির সাথে ভাত-ব্যানুন রাঁধতে ছিল। ময়না যতবাব ডাক  দিলো, “ মই এইহানে ভাইয়্যা।”
মনু হাঁটতে হাঁটতে ঝামেলা বিবির পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। ঝামেলা বিবির আদর একটু বেড়ে গেল- একটা পিঁড়িঁ দিয়ে কইল, “নে মনুন্যা বহ।”
“না চাচিমা ঘরে যামু। ময়না ভাত খামু কি দিয়া।”
ময়নার বয়স সবে মাত্র সাত বৎসর। ময়না কি ভাল করে রাধঁতে যানে ? ঝামেলা বিবির কাছে সব কিছু তৈয়ার করে দেয় ঝামেলা বিবি রাঁন্না করে দেয়। ময়না বলে,
“ ভাইয়্যা চাচায় কয়ডা চিংগইর মাছ দেছে ভর্তা বানাইয়া থুইছি।”
মনু ঝামেলা বিবির কাছে একটু তরকারী আপত্তি করে বলে,
“ চাচিমা মোগো দুই বাই-বোনেরে একটু শালুন দেবেন।”
ঝামেলা বিবি বলে, “শালুন পামু কই ? অল্প রানছি দেওয় যাইবে না আর একদিন নিস।”
মনু সামান্য কষ্ট পেল তবুও কিছু বলে নাই। ঘরে চলে গেল। চিংড়ি ভর্তা দিয়ে অল্প ভাত খেয়ে ছোট্র কুড়ের ঘরে বোন ময়নারে লয়ে ঘুমিয়ে পরল।

সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে ওসমানের ঘরে ডুকে বলল, ওসমান যেন মনুর গরু-মহিষ কয়টা ছেড়ে দেয়। নিজে এক আটা লাকড়ি বিক্রি করে চাউল, সওদায় কিনে ময়নার কাছে দিয়ে চরে যাইবে গরু-মহিষের নিকট। মনু লাকড়ি বিক্রি করতে চলে গেল। রাখাল দল একাত্র হয়ে মনুর গরু-মহিষ ছেড়ে দিল। মনু লাকড়ি বিক্রি করে মিশ্রিপাড়ার ছোট্র হাট থেকে অল্প অল্প চাল, ডাল,হলুদ, মরিচ, পেয়াজ এবং ময়নার জন্য দু’টাকার আচার কিনে চলে আসল। সওদায় রেখে আধা পেডি পান্তা ভাত খেয়ে চলে গেল গঙ্গামতির চরে। মনুর হাতে গাটিয়া কচার একটা লাঠি মাথায় লাল ছিড়া গমছা প্যাঁচানো। বাতাসে উড়ে বালু জমা হয়ে বড়ো ওয়াবদা রাস্তার মতো উঁচু হয়ে থাকা বালুর উপরে অগুনিত মৌফল গাছের ফাঁকে ফাঁকে হাঁটতে হাঁটতে কিছু সামনে এগুতেই দেখতে পেল বিশাল গরু-মহিষের দল। কিন্ত ওর রাখাল বন্ধুরা কোথায় ? মনু আবুল আবুল বলে কয়েকটা ডাক দিলো কোন সারা নাই। মনু বিস্তর বড়ো একটা কদম গাছের নিচে ছিড়া গামছাটা বিছিয়ে শুয়ে রইল।

গরু-মহিষ গুলো জমাট বাধা রাস্তা ও বিস্তর বড়ো জঙ্গলের মাঝখানে কয়েকশত একর জমির উপর ছন ক্ষেতের মধ্যে ঘাস খাচ্ছে। ওরা চারজন জঙ্গলের মধ্যে হ্যাতাল গাছের মাথা কেটে নরম অংশ অর্থাৎ মাতি খেতে গেছে। চুপি চুপি মাতি খেয়ে জঙ্গল থেকে বের হয়ে আসল ওরা কারন বন প্রহরীগণ দেখলে ঝামেলা হবে তা ওদের অজানা নয়। একে তো বছরে গরু-মহিষ প্রতি টাকা দিতে হবে। না দিলে ঝামেলা আছে।

মনু অনেক সময় কদম গাছের নিচে প্রতিক্ষা করে গরু-মহিষ  ঠিক ঠাক দেখে সাগর চরে নামল। একটু তফাতে দেখে ছোট একটি মরাপঁচা সু-মাছ তরঙ্গের তোয়ে ভেসে কিনারায় উঠেছে। পচাঁ গলা মাছটাকে একদল লাল কাকঁড়ায় খাচ্ছে চারদিক ঘেরাও করে। দূর হতে সু-মাছ দেখা যাচ্ছিল না। মনু জোরে সোরে দৌড় দিয়ে নিকটে পৌছতে না পৌছতেই লাল কাকঁড়া নাই হাওয়া হয়ে গেছে মনে হয়। কিন্তু লাল কাকঁড়া নিজেদের শক্ত ধারালো দু’পায়ের দ্বারা তৈরী ক্ষনস্থায়ী বাসভবন গর্তে ডুকে গেল। পচাঁ মাছের দুর্গন্ধে নাকে ছিড়া গামছা দিয়ে চেপে ধরে ফারাকে চলে আসল। ফিরতি তাঁকিয়ে দেখে পুনরায় লাল কাকঁড়া গুলো জমা হয়ে গেছে। লাল কাকঁড়া গুলোকে বলা হয় ভাটার কাকঁড়া। সাগরে ভাটা হলে দেখা যায় জোয়ারে কোথায় লুকায় বলা যায় না। ধারনা করা হয় জোয়ারের সময় বালুর নিচে থাকে। মনু ফিরতি তাড়া করতে তফাত থেকে একটা শক্ত মোটা লাঠি মারল।

যতক্ষন মনু কাকঁড়ার সঙ্গে লুকোচুরি খেলল ততক্ষনে অন্য রাখাল দল জঙ্গলের ভেতর থেকে হ্যাতাল মাতি খাওয়া শেষ করে ছন ভিটায় এসে কমজা গাছের তলায় শুকনো ছন বিছিয়ে বসছে। মনু পিছন থেকে দুষ্ট মনে ভূতের ভয় দেখাতে চেষ্টা করল বটে- সফল হতে পারে নাই। ওসমান বলে উঠে, ‘মনুন্যা মোগোরে ভূতের ডর দেহাইসনা, মোরা ডরাই না-ভূত মোগোরে ডরাইয়া পলাইয়া যায়।’
‘হ বুঝ্ঝি। যেকালে ভূতে দরবে হেকালে বুঝবি ভূত তোগোরে ডরায় না তরা ভূতেরে ডরাও।’
মনু জিজ্ঞাস করল ওরা কোথায় গেছিল-
 ‘মুই তোগোরে বিরচাইতে বিরচাইতে লাল কারড়্যা লড়াইতে গেছি।’
ওরা বলে,‘ মোরা এতাল মাতি গিলতে গ্যাললাম।’
মনু বলে, ‘মোর লইগ্যা আনো নাই ?’

‘না আনতে পারি নাই। আনমু ক্যামনে জঙ্গলের মধ্যে যাওয়া লাগে পাশে পাশে পাওয়া যায় ? অল্প কয়ডা পাইছি মোরা খাইয়া আইছি।’
বেলা বারোটা বাজলে গরু-মহিষের জলের পিপাষা লাগে সাগরের পানি লবনাক্ত হয়ে যাবে অল্প দিনের মধ্যে -তা ওদের অজানা নয়। মিঠা পানির জন্য ছন ভিটার ফাঁকে ফাঁকে কোদাল দিয়ে মাটি বালু খনন করে ছোট ছোট কুয়া বা ডোবা করলে গভীর থেকে মিঠা পানি উঠবে। গত বছরের ডোবা গুলো ভরাট হয়ে গেছে। এ বছর আবার নতুন করে ডোবা খনন করতে হবে-তা পুরানো কথা না।
গনি সকলের দৃষ্টি আকর্ষন করে বলে, ‘ইন্দিরা ছালাইতে অইবে না।’(ওদের ভাষায় কূপের নাম ইন্দিরা)
ওসমান বলে, ‘এ বচ্চর আরো চাইর পাচটা বেশি ছালাইতে অইবে।’

কারন এ বছর রাখাল মনুর গরু -মহিষ গুলো গঙ্গামতির চরে বাড়তি। সর্ব রাখাল দল এই সিন্ধান্তে উপনীত হলো যে, আগামী কাল থেকে কূপ খনন করবে।
আবুল বলে, ‘কাইল সবে একটা কইরর‌্যা কোদাল আনবি।’
মনু কোথায় পাবে কোদাল ? গনি বলে, ‘তর আনা লাগবে না, তুই একটা হাজি (ঝুড়ি বা ডালা) আনিস।’
মনুর তাও নাই করবে কি ? গনি বলে, ‘ হ্যালে তুই একটা গাবলা (গামলা) আনিস।’মনুর গামলা ছোট সেটায় হবে কি ? আবুল বলে ,‘ একটা ঐলিই ঐইবে আনে।’
কিছু সময় শলাপরামর্শ করার পর সকলে মিলে এলো মেলো গরু-মহিষ গুলো একাত্রিত করে মৌফল গাছের তলায় রেখে রাখাল পাড়ায় দুপুরের খানা গিলতে চলে আসল।
মনু রাখ্খালী রাখা গরু-মহিষ গুলো এদিক-সেদিক ছোটা-ছুটি করে কিনা চাঁনমিয়া জানতে চাইলে মনু বলে, ‘না দৌড়া-দৌড়ি করে না ঘাস আছে ব্যামালা খাইয়া পেট গোল কইরর‌্যা হালায়।’

চাঁনমিয়া বলে, ‘বাজান ভাত খাইয়া জলদি যা নাইলে বাস্তাহারা গ্রামে যাইবে। কেহ খরে দেলে টাহা লাগবে ?’
‘হ চাচা’ বলে চলে গেল নিজের ঘরে। ছোট বোন ময়না ছোট্র মানুষ ভাইর জন্য ভাত রেডি করে বসে আছে। মনু দরজায় ডাক দিলো, ‘ময়না ........ ও মোর কইলজার টুকরা বোইনডা কই....... গেলি কই?’
‘মুই এইহানে ভাইয়্যা তোমার লইগ্যা ভাত রেডি করছি।’
‘ আ....... বোকা বোইন নাইতে অইবে না ?’
ময়না বলে, ‘ হয় ভাইয়্যা তোমার কাপুর উডানে দড়ির লগে থুইয়াইছি।’

মনু গোসল সেরে ভাত খেয়ে চলে গেল গঙ্গামতির চরে গরু-মহিষ যেখানে। গরু-মহিষ গুলো গাছ তলার ছায়ায় শুয়ে শুয়ে কাচা ঘাস, লতা-পাতা পেটের ভিতর থেকে ডোক এনে চিবাইতেছে। আর লম্বা লেজের মাথায় গোছা চুল দিয়ে মশা-মাছি তাড়াচ্ছে। কিছু সংখ্যক ঘাস খাওয়ার জন্য হাটতে শুরু করছে। মোট কথা গবাদি পশুর যা স্বভাব তা করছে।  মনু কাঁধের গামছাটা একটা বিস্তর বড়ো হাড়রা গাছ তলায় ছায়ায় শুকনো বালুতে বিছিয়ে এক খন্ড শুকনা গাছের উপর মাথা রেখে শুয়ে পরল। অল্প সময়ের মধ্যে দক্ষিনা পবনে নিদ্রা দেবীর কোলে ঘুমিয়ে পরছে।  ততক্ষনে রাখাল মনুর রাখাল বন্ধুরা এসে দেখল দক্ষিনা হাওয়ায় মনুর সারা শরীরের উপর একইঞ্চি পরিমান বালু জমা হয়ে আছে। ওসমান মনুরে ডাক দিয়ে বলে, ‘এ ...... ব্যাডা কয়দিন ঘুমাও নাই যে এই রহমের ঘুমাইছ ?’
মনু চমকে উঠে বলে, ‘ উহু ....... ।’  আরে কোন কথা বলে নাই।

ততক্ষনে গরু-মহিষ গুলো বিশ্রাম হতে উঠে ধীরে ধীরে  এলো-মোলো ভাবে গাছের ফাঁকে ফাঁকে ছন ভিটায় রুজির সন্ধানে হাঁটতে  আরাম্ভ করছে। ওরা পাঁচজন পিছনে পিছনে দুষ্টামি করতে করতে চলে গেল। গরু-মহিষ গুলো কোনটা ছন ভিটায় কোনটা গাছের লগে জড়ানো লতা-পাতা খাইতে আরাম্ভ করছে। আবুল বলে,
‘মোগো গরু-মহিষ রাখতে কোন কষ্ট অয়না খালি বাস্তহারা গ্যারামে য্যানো না যাইতে পারে হেইয়্যাই দ্যাখতে অইবে। মোরা হক্কলডি পাতাছিট খেলামু।’

পাতাছিট খেলতে আরাম্ভ করে দিলো - পাঁচজনে পাঁচ রকম পাঁচটি করে পাতা ছিড়ে, পাতলা ছিড়া একটা গামছা পেতে তাস খেলার মতো গোল করে বসলো। পাতাগুলো একাত্র করে এক একজনে এক এক রকমের পাঁচটি পাতা পড়নের কাপড়ের টোবরে লইলো। একটা ছোট কাঠি লয়ে (ওরা বুড়িয়া বলে) পাতা চালতে আরাম্ভ করে। যার আগে এক ধরনের পাঁচটি পাতা হবে সে ছিট বলে চিৎকার দিবে। সবাই মেনে নিবে। এভাবে কিছুক্ষন পাতাছিট খেলতে খেলতে গরু-মহিষ গুলো এলো-মেলো হয়ে গেল। সকলে মিলে চৌতুর দিক হতে তাড়িয়ে একাত্র করে পুনরায় পাতাছিট খেলতে বসল।

সন্ধার আগে গরু-মহিষ মশার তাড়নায় ধীরে ধীরে সাগরের স্যাঁত-স্যাঁতে বালুতে আসতে আরাম্ভ করল। ওরা গরু-মহিষ তাড়িয়ে খালের কিনারায় আনল। অর্থাৎ যে খালটা সাগরের মোহনা হতে গভীর জঙ্গলের ভিতর দিয়ে চাপলী বাজারের পানে অগ্রসর হয়েছে। গবাদি পশু  একাত্র করে আর মনুর নতুন গুলো আগের জায়গায় বেধেঁ রাখাল পাড়ায় চলে আসল।

গরু-মহিষ চোরে নেবার পদ্ধতি আছে বটে-কিন্তু আবুলের বাবা শানু ঘরামী ও ওসমানের বাবা হায়দার আলী গরু-মহিষের ওখানে জঙ্গলের কিনারায় উঁচু বালুর দুমে ছোট টিলার মতো দেখতে একটি বড়ো কেওড়া গাছের আড়ালে বাশেঁর কঞ্চির মতো সরু গেওয়া গাছের কচা দিয়ে মাচা পেতে, বলই গাছের লম্বা ডাল দিয়ে, নৌকার ছাউনীর মতো বাঁকা গোল করে, শুকনো ছনের ছাউনী দিয়ে বাসা তৈরী করে, সমস্ত রাত্র জেগে বাগদা চিংড়ি মাছের পোনা বা রেনু ধরে। সে কারনে গরু-মহিষ চোরে নেবার সম্ভাবনা কম। আর তাই ওদের রাত্র জেগে পাহারা দিতে হয় না । বাড়ীতে ঘুমাতে পারে  নিচিন্তে।
এভাবে কয়েকদিন চলে গেল। মনু এখনও মাহিনা পায় নাই। বাড়ীতে আনা শুকনো লাকড়িঁ ফুরিয়ে গেছে। পরের দিন সকালে গঙ্গামতির চরে গরু-মহিষ ছন ভিটায় রেখে রাখাল বন্ধুদের বলে, ‘ তরা মোর গরু-মইস দেহিস মুই জোঙ্গোলে যাই।’
রাখাল দলে মধ্যে রাছেল একটা বজ্জাত। কারো কোন উপকার করতে চায় না। ওর দ্বারা কারো উপকার হউক তা ওর কাম্য নয়। রাছেল কয় ,
‘মোরা কেহ তর গরু-মইস দ্যাখতে পারমু না।’
ওসমান বলে, ‘রাছের ক্যান দ্যাখতে পারমু না ?’
রাছেল কয়, ‘তরা দ্যাখলে দ্যাহিস মুই পারমু না।’
গনি বলে, ‘তুই না দ্যাখলে না দ্যাহিস......তো কতা বারাইস না।’
মনুরে লক্ষ্য করে বলে, ‘মনু তুই যা জোঙ্গোলে মুই দ্যাখমু আনে।’
ওসমান মায়বী কন্ঠে বলে,‘তুই এ্যাল¬া জোঙ্গোলে যাবি ক্যান ?’
মনু বলে,‘এ্যাহনও মায়না পাইতে দেরি আছে। বাড়ী দাউর নাই না বেচলে খামু কি ?’
ওসমান আরো দরদী হয়ে বলে, ‘ মনু   ল   মুই যামু লগে।’

ওসমানকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেল জঙ্গলে লাকঁড়ি কাটতে। আটা দুই লাকঁড়ি কেটে মাথায় করে গন্তব্যে আসল। সন্ধ্যাকালে রাখাল পাড়ায় আসার সময় এক আটা আবুলের বাবর বাসায় রেখে এক আটা মাথায় করে নিয়ে আসল। পরের দিন সকালে বিক্রি করে সওদায় ও ছোট বোন ময়নার জন্য দু’টাকার চিনাবাদাম কিনে আনল। তারপর চলে গেল গঙ্গামতির চরে গরু-মহিষ যেখানে।
সকলে কোদাল নিয়ে ইন্দিরা খনন আরাম্ভ করল। পুরানো ইন্দিরা খনন করতে সময় ব্যয় হলো কম। দিন দুইর মধ্যে একটা নয়, দুটো নয়, পাঁচটা নয়, দশটা খনন করে ওসমান বলে,
‘ আইজ আর পারমু না আবার কাইল।’
আবুল বলে, ‘কাইল না কয়দিন পর এ্যাহন বেশি লাগবে না, গরম বেশি পরে না।’
দশটায় না হলে আবার ইন্দিরা খনন করবে বলল আবুল। সবাই সায় দিয়ে গরু-মহিষ গাছের ছায়ায় একাত্র করে রেখে রাখাল পাড়ায় চলে গেল।
--------------********-------------

No comments

Powered by Blogger.