গঙ্গামতির রাখাল-(পর্ব-দুই)
গঙ্গামতির রাখাল-(পর্ব-দুই)
Novel Cover Photo
এক মাস পরের কথা।
আশ্বিন মাস। প্রতি বৎসর আশ্বিন মাস কম বেশী জলোচ্ছ্বাস হয়। এ বৎসর জলোচ্ছ্বাস এত বেশী হলো যে, বিলে কোথাও একটু জায়গা নাই যেখানে দাঁড়িয়ে ভাসমান হাঁসগুলো বিশ্রাম নিবে। কৃষকের কষ্ট করা স্বপ্নের সোনালী ধানের রোপন করা চারাগুলো তুমুল বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে। কৃষকের মনে হতাশার জন্ম হলো। আর কয় দিন জল জমা থাকলে ধানের চারাগুলো নষ্ট হয়ে যাবে।
গণির বাবা আজিজ পহলান ও রাছেলের বাবা মোস্তফা আকনের হতাশার সৃষ্টি হলো আরো বেশী। কারণ নিজেদের চাষের জমি সামান্য। মাত্র তিন বিঘা করে তাও আবার একসনা রাখা অর্থাৎ এক বছর চাষাবাদ করে ফসল তুলে ছেড়ে দিতে হবে। না হলে আবার ফিরতি টাকা দিতে হবে। অন্য মহাজনের জমি বর্গা বা ভাগে চাষ করে ধানের চারা রোপন করেছে। মহাজন শিপন তালুকদারের ধানের চারা নষ্ট হলে সমস্যা হবে না- তার মাছ ধরার পাঁচ খানা ট্রলার আছে। মস্তফা আকনের মহাজন শহজাহান মজুমদার গ্রামে বসবাস করেন না ওনার চারখানা মালটানা ট্রাক ও দু’খানা যাত্রবাহী বাস গাড়ী আছে। যার জন্য উনি বিভাগীয় শহর বরিশালে পরিবার সহ বসবাস করেন।
সাগরের জল উপকূল লোকালয়ে ডুকতে বাঁধাকারী বন্যা নিয়ন্ত্রন বেড়িবাঁধ ছাড়া রাখাল পাড়া ও আশে-পাশের সমস্ত রাস্তা-ঘাট, বাড়ির উঠান, কারো কারো বারান্দা জলের তলায় ডুবে গেছে। মনুর ছোট্ট কুড়ের ঘরটা একফুট পানির তলে তলিয়ে গেছে। মনুর বোন ছোট্ট ময়না ঘরে থাকবে কেমন করে ? মনু এক আটা বাঁশের কঞ্চির মতো সোজা গেওড়া কচা কেটে মাচার মতো পেতে দিলো। চাঁনমিয়ার ঘরের ভিটাটা ছিল একটু উঁচু। তাই জলোচ্ছ্বাসের পানি ঘরে প্রবেশ করতে পারে নাই। শুধু পাকের ঘরটা তলিয়ে গেছে। ঝামেলা বিবি ঘরের মেঝেতে একটা অস্থায়ী চুলা খুঁদে ভাত-ব্যনুন রাঁধতে আরাম্ভ করল। ময়নাও ঝামেলা বিবির সঙ্গে ভাত-ব্যনুন রাঁধে।
ঝামেলা বিবি একটু ঝামেলা মনে করত বটে- কিন্তু স্বামী চাঁনমিয়ার ভয়তে মুখে কিছুই বলতে সাহস পায় না। গত বছর একদিন মুখে বলে ছিল “পরের পোলা”। কথাটা শুনে চাঁনমিয়া এমন মার দিলো সাত দিনের মধ্যে ঝামেলা বিবি নড়া-চড়া করতে পারেনি। যদিও চাঁনমিয়া পরে চাপলীর হাট থেকে ছয় টাকার ক্যাপসুল এনে দিয়েছিল। সেই থেকে ঝামেলা বিবির বাম হাতের মাঝের আঙ্গুলটা ভাঙ্গা। ভাঙ্গা আঙ্গুল নিয়ে কাজ করে তবুও কোন কথা বলার সাহস পায় না। আঙ্গুলে নাড়া লাগলেই কথাটা মনে পরে যায়।
এদিকে মনু ও তার রাখাল বন্ধুরা বিষম অসুবিধায় পরে গেলো। গরু-মহিষের কাছে যেতে হয় জেলেদের নৌকায়, জঙ্গলের গহিনের আঁকা-বাঁকা পথটা কমছে কম পাঁচ হাত পানির নিচে। এদিকে গরু-মহিষ শুধু উঁচু টিলার মতো দেখতে বালুর দুমের উপর ছাড়া অন্য কোথায় যাওয়ার জায়গা নাই। দুমের উপরে গাছের লতা-পাতা খাওয়া শেষ হয়ে গেছে। বালুতে মিষ্টি আলুর লতার মতো দেখতে গোস্তলতার পাতাগুলো খাওয়া শেষ লতাও নাই। সব খেয়ে ফয়লা করেছে। মহিষগুলো পানির মধ্যে সাঁতার কেটে কেটে গাছের পাতা খাইতেছে। মনু রাখাল বন্ধুদের উদ্দেশ্য করে বলে,
“মুই দ্যাখছি তরা কোন চিন্তা করিস না, গরুতে খাইবে কী ?
আবুল বলে, “তর চিন্তা হরতে অইবে না, সাগরে ঢালা পরলে দু’একদিনের মধ্যে পানি টাইন্যা যাইবে আনে”।
“মোরা ঐহানে ল ডান্ডি খেলামু আনে” ওসমান বলে। সকলে সায় দিয়ে একটু তফাতে খোলামেলা জায়গা নির্বাচন করে “ডেং” খেলতে আরাম্ভ করল।
আশ্বিন মাস। প্রতি বৎসর আশ্বিন মাস কম বেশী জলোচ্ছ্বাস হয়। এ বৎসর জলোচ্ছ্বাস এত বেশী হলো যে, বিলে কোথাও একটু জায়গা নাই যেখানে দাঁড়িয়ে ভাসমান হাঁসগুলো বিশ্রাম নিবে। কৃষকের কষ্ট করা স্বপ্নের সোনালী ধানের রোপন করা চারাগুলো তুমুল বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে। কৃষকের মনে হতাশার জন্ম হলো। আর কয় দিন জল জমা থাকলে ধানের চারাগুলো নষ্ট হয়ে যাবে।
গণির বাবা আজিজ পহলান ও রাছেলের বাবা মোস্তফা আকনের হতাশার সৃষ্টি হলো আরো বেশী। কারণ নিজেদের চাষের জমি সামান্য। মাত্র তিন বিঘা করে তাও আবার একসনা রাখা অর্থাৎ এক বছর চাষাবাদ করে ফসল তুলে ছেড়ে দিতে হবে। না হলে আবার ফিরতি টাকা দিতে হবে। অন্য মহাজনের জমি বর্গা বা ভাগে চাষ করে ধানের চারা রোপন করেছে। মহাজন শিপন তালুকদারের ধানের চারা নষ্ট হলে সমস্যা হবে না- তার মাছ ধরার পাঁচ খানা ট্রলার আছে। মস্তফা আকনের মহাজন শহজাহান মজুমদার গ্রামে বসবাস করেন না ওনার চারখানা মালটানা ট্রাক ও দু’খানা যাত্রবাহী বাস গাড়ী আছে। যার জন্য উনি বিভাগীয় শহর বরিশালে পরিবার সহ বসবাস করেন।
সাগরের জল উপকূল লোকালয়ে ডুকতে বাঁধাকারী বন্যা নিয়ন্ত্রন বেড়িবাঁধ ছাড়া রাখাল পাড়া ও আশে-পাশের সমস্ত রাস্তা-ঘাট, বাড়ির উঠান, কারো কারো বারান্দা জলের তলায় ডুবে গেছে। মনুর ছোট্ট কুড়ের ঘরটা একফুট পানির তলে তলিয়ে গেছে। মনুর বোন ছোট্ট ময়না ঘরে থাকবে কেমন করে ? মনু এক আটা বাঁশের কঞ্চির মতো সোজা গেওড়া কচা কেটে মাচার মতো পেতে দিলো। চাঁনমিয়ার ঘরের ভিটাটা ছিল একটু উঁচু। তাই জলোচ্ছ্বাসের পানি ঘরে প্রবেশ করতে পারে নাই। শুধু পাকের ঘরটা তলিয়ে গেছে। ঝামেলা বিবি ঘরের মেঝেতে একটা অস্থায়ী চুলা খুঁদে ভাত-ব্যনুন রাঁধতে আরাম্ভ করল। ময়নাও ঝামেলা বিবির সঙ্গে ভাত-ব্যনুন রাঁধে।
ঝামেলা বিবি একটু ঝামেলা মনে করত বটে- কিন্তু স্বামী চাঁনমিয়ার ভয়তে মুখে কিছুই বলতে সাহস পায় না। গত বছর একদিন মুখে বলে ছিল “পরের পোলা”। কথাটা শুনে চাঁনমিয়া এমন মার দিলো সাত দিনের মধ্যে ঝামেলা বিবি নড়া-চড়া করতে পারেনি। যদিও চাঁনমিয়া পরে চাপলীর হাট থেকে ছয় টাকার ক্যাপসুল এনে দিয়েছিল। সেই থেকে ঝামেলা বিবির বাম হাতের মাঝের আঙ্গুলটা ভাঙ্গা। ভাঙ্গা আঙ্গুল নিয়ে কাজ করে তবুও কোন কথা বলার সাহস পায় না। আঙ্গুলে নাড়া লাগলেই কথাটা মনে পরে যায়।
এদিকে মনু ও তার রাখাল বন্ধুরা বিষম অসুবিধায় পরে গেলো। গরু-মহিষের কাছে যেতে হয় জেলেদের নৌকায়, জঙ্গলের গহিনের আঁকা-বাঁকা পথটা কমছে কম পাঁচ হাত পানির নিচে। এদিকে গরু-মহিষ শুধু উঁচু টিলার মতো দেখতে বালুর দুমের উপর ছাড়া অন্য কোথায় যাওয়ার জায়গা নাই। দুমের উপরে গাছের লতা-পাতা খাওয়া শেষ হয়ে গেছে। বালুতে মিষ্টি আলুর লতার মতো দেখতে গোস্তলতার পাতাগুলো খাওয়া শেষ লতাও নাই। সব খেয়ে ফয়লা করেছে। মহিষগুলো পানির মধ্যে সাঁতার কেটে কেটে গাছের পাতা খাইতেছে। মনু রাখাল বন্ধুদের উদ্দেশ্য করে বলে,
“মুই দ্যাখছি তরা কোন চিন্তা করিস না, গরুতে খাইবে কী ?
আবুল বলে, “তর চিন্তা হরতে অইবে না, সাগরে ঢালা পরলে দু’একদিনের মধ্যে পানি টাইন্যা যাইবে আনে”।
“মোরা ঐহানে ল ডান্ডি খেলামু আনে” ওসমান বলে। সকলে সায় দিয়ে একটু তফাতে খোলামেলা জায়গা নির্বাচন করে “ডেং” খেলতে আরাম্ভ করল।
ডেং খেলা শুরু করল- প্রথমে দু’জনে মাটিতে ছোট্ট একটি গর্ত করে হাতের চার আঙ্গুল সমান গাছের শক্ত ডাল দিয়ে ‘ডান্ডি’ তৈরী করে। ‘ডান্ডি’ গর্তের উপর আড়াআড়ি রেখে হাতের লম্বা লাঠি দিয়ে নির্দিষ্ট সীমানায় মারবে। প্রতিপক্ষ হাতের লাঠি দিয়ে ছুঁইতে (ওদের ভাষায় টোক) পারলে সে আউট হয়ে যাবে। আর ছুঁইতে না পারলে ছোট ‘ডান্ডি’ গর্তে ফেরৎ পাঠাবে। ঠিক গর্তে না পরলে হাতের লম্বা লাঠি দিয়ে ডেং মারবে। ডেং যতদূরে যাবে সেখান থেকে লম্বা লাঠি দিয়ে মেপে গর্তে ফিরে আসবে। আর যদি ডেং মারার সময় দোবারি (দুই বার) পরে তাহলে ডেং দিয়ে মেপে আসবে। গুনিতে বিশ লাঠি হলে ‘এক কুড়ি’ হবে তার পক্ষে অন্য একজন উঠবে। এবাবে চলতে থাকবে। চলতে চলতে যেদল জয়ী হবে সেদল ছোট্ট ‘ডেং’ টি লুকাবে পরাজিত দলকে খুঁজে বের করতে হবে। এভাবে ডেং বা ডান্ডি খেলা চলে।
সমুদ্র উত্তাল হওয়ার জন্য অনেক জেলেরা জালের নিকট মাছ আনতে যেতে পারবে না-সেটা সবার জানা আছে। জালে বাজা মাছগুলো তুফানের ধাক্কায় ধাক্কায় ছুটে ফুলে ভাসতে ভাসতে কিনারায় আসছে। কোনটা সম্পূর্ণ পচে গলে গেছে, কোনটা অর্ধ পচা। খাওয়ার উপযুক্ত আছে বটে- তবে ভাজি বা ঝোল নয়, ঝুড়া করে খাওয়ার মতো। ওরা সকলে খাওয়ার মতো আছে- সেরকম মাছগুলো বেছে বাড়িতে নিয়ে আসল। মনু একটা নয়, দু’টো মাছ নিয়ে এসে ছোট বোন ময়নার হাতে দিয়ে বলে,
‘ ময়না কলিজার টুকরা বোইন মোর, ভাল কাইর্যা ঝুরা করিস’।
ময়না ঠিক পারবে ঝুড়া করতে ? ময়না নাখোস করে বলে, ‘মুই পারমু না, চাচিমার কাছে লইয়া যামু আনে’। মনু সায় দিয়ে কাপড় নিয়ে গোসল করতে চলে গেল। গোসল শেষে ঘরে এসে ময়নারে বলল, ময়না যেন মনুর জন্য ঘরে পাতানো চকিতে বিছানা করে দেয়। ময়না বিছানা ঠিক করে দিয়ে ঝামেলা বিবি নিকট চলে গেল। মনু বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পরল। আজ মনুর চিন্তা নাই গরু-মহিষ নিয়ে, চারদিকে পানি যাবে কোথায়? পচা ইলিশ মাছ ঝুড়া করে ঝামেলা বিবিরে অর্ধেক দিয়ে যতক্ষনে ময়না ঘরে ফিরল ততক্ষনে মনু নিদ্রা দেবীর কোলে ঢলে পরে স্বপ্ন দেখতে আরাম্ভ করল। ময়না কচি কন্ঠে ডাক দিয়ে বলল, ‘ঝুড়া অইয়্যা গ্যাছে ভাইয়্যা, ওঠো ভাত খাইবা না’। মনু উহু... করে আবার ঘুমের কোলে ঢলে পরল। ময়না ফিরতি ডাক দিতে না দেতেই মনু স্বাভাবিক হয়ে উঠে ভাত খেয়ে গঙ্গামতির চরে চলে গেল। অন্যরা মনুর আগে গন্তব্যে উপস্থিত ছিলো। রাছেল বজ্জাতটা উঠে বলল,
‘মনুন্যা বাড়ি গ্যালে মহিষ-গরুর কতা মোনে থাহে না’ ?
মনু কিছু বলার আগে ওসমান জবাব দিলো,
‘রাছিলল্যা তুই কোলো হক্কল সময় মন্যন্যার লগে রিশ কর, বাল অইয়্যা যা নালে গোমা কচা দিয়া হক্কল্ডি তরে পিডামু’।
রাছেল আর কোন কথা বলে নাই। সকলে মিলে সকালের মতো ডেং বা ডান্ডি খেলতে আরাম্ভ করল। ঘন্টা খানেক খেলার পরে আবুল দেখল সাগরের আধা কিলো মাঝখানে বেশ বড় একটা কনটিনার দক্ষিণা বাতাসে ভেসে আসছে। আবুল পহেলা কনটিনার কিনা তা সনাক্ত করতে পারেনি। পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আবুলের এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকা দেখে অন্যদের দৃষ্টিগোচর হলো। আবুল সবার আগে পড়নের কাপড় নেংটি দিয়ে সাগরে ঝাপ দিলো। সঙ্গে সঙ্গে অন্যরাও পরেছে বটে-কিন্তু মনু একেবারে সবার পাছায়। সনাক্তবিহীন বস্তুটি ধরার জন্য। আবুল মোটা তাজা টকবগে যুয়ান রাখাল- সেটা কাজে প্রমান করেই ছাড়বে। তাই সবার আগে কাম্য বস্তুটি ধরার জন্য অগ্রসর হয়ে গেলো। কিন্তু আবুলের জানা ছিলো না- যে কাম্য বস্তুটি সে স্পর্শ করতে যাচ্ছে- সেটা ওর “দেহাশ্রিত পরলোকে গমন করবে”।
আবুল বস্তুটি সনাক্ত করে কনটিনারটি হাতে নিয়েছিল বটে-কিন্তু সাগরের তোয়ে নেচে ওঠা হিল্লোল মস্তবড় উঁচু হয়ে আবুলের তর-তাজা দেহটাকে গায়েল করে ফেলল। মনু,ওসমান, রাছেল ও গনি দেখল আবুল ধরেছে- ওরা ফিরতি তটে আসতেছে। কিন্তু পরোক্ষনে তাকিয়ে দেখে ‘আবুল গায়েল কনটিনার উধাও’। দু’ এক ঘন্টাও কি ওরা সাগরের উত্তাল তরঙ্গে দৃষ্টি শক্তি দিয়ে তাকিয়ে ছিলো না ? কোথাও আবুল নামের যোয়ান সাহসী রাখাল বন্ধুর সন্ধান মিলল না। ভাটায় সাগর এক কিলোর মতো শুকিয়ে গেল। আবুল সেখানে গায়েল হয়েছে সেখান থেকেও পানি গজ পাঁচের মতো শুকিয়ে নামায় নেমে গেছে। আবুলের সন্ধান মেলে নাই। ওদের ধারণা আবুল যদি মারা যায় তাহলে মৃত্যু দেহটা তটে আসবে-তাও আসল না। তাহলে কি ভাসমান বস্তুটি দেও-দানব ছিলো ? ওরা চারজন সাগরের কূলে কূলে ছোটা-ছুটি করল, আবুল আর ফিরে আসল না, খোঁজও পাওয়া গেল না। আবুল যে রাখাল বন্ধুদের ছেড়ে উপর ওয়ালার নির্দেশে প্রানকাড়া সর্বনাশা সাগরের তোয়ে মিশে গেছে- ওরা কি বিশ্বাস করতে পারবে ? কল্পনা করা যায় কি ? বিশ্বাস আমারও হতো না।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসে ধরণী ঘনকালো কালিমার হালকা কুয়াশায় সজ্জিত হয়ে গেল। গরু-মহিষ গুলো আস্তে আস্তে পা পা করে গন্তব্যে চলে আসল। মনে হবে আবুলের গায়েল হবার সংবাদটা নির্বোধ গবাদি পশুর কানে পৌছে গেছে। ওরা চারজন একজন সঙ্গীহারা হয়ে বেদনা বিধূর যন্ত্রনা নিয়ে বাড়ি রহনা হলো। কিন্তু একটু তফাতে অগ্রসর হওয়ার মধ্যেই আবুলের জন্ম দাতা বাপ শানু ঘরামীর সাথে দেখা হয়ে গেলো। শানু ঘরামী বাগদার পোনা ধরার জন্য মাচন পাতা ছনের বাসায় আসতেছে। নিজের বুকের মানিক ধন আবুলকে না দেখে জিজ্ঞাসা করল, আবুল ওদের সঙ্গে নাই কেন ? ওরা কি জবাব দিবে ? ওরা চারজন রাখাল বটে- তবুও তো ওদের মধ্যে মানবতার মমতাবোধ, বেদনা লুকায়িত আছে। আননে কোন কথা না বলে নিরূপায় হয়ে শানু ঘরামীর সন্নিবেষ্টিত হয়ে মাথা হেও করে দাঁড়াল। শানু ঘরামী উচ্চস্বরে করুণ কন্ঠে বলল,
‘ও ব্যাডারা তরা কতা কইছ না ক্যান মোর পোলা আবুল কোয়ানে, তরা হক্কল্ডি মিল্ল্যা মর আবুলেরে হি হরছো’ ?
তারপরও ওরা আনন হতে কোন কথা বের করল না। শানু ঘরামী নিজেকে সামাল দিতে না পেরে ওসমানের গায় ধরে ধাক্কা দিয়ে বলল,
‘কতা কয় তরা কতা কয়’।
মনু সর্ব কনিষ্ট হলেও বুঝতে বাকী নাই শানু ঘরামী ওদের সন্দেহ করেছে। তাই মনু বলে উঠল “মোরা আমনের পোলারে কছু হরি নাই”।
তারপর ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা বলে দেওয়া হতে বিরত থাকল না। শানু ঘরামী শুনে ‘হায়রে আবুল হায়রে আবুল বলে স্যাঁতে স্যঁতে বালুতে লুটিয়ে পরল। কত গড়া-গড়ি, কত মাখা-মাখি করল তা আননে আনা যায় ? শানু ঘরামীর বুঝার বকেয়া থাকল না যে, আবুল আর ফিরে আসবে না। তবুও বুকের মধ্যে আশা সঞ্চয় করে মিট মিট করে জ্বলা টর্চ লাইট হাতে লয়ে সাগরের কিনারায় কিনারায় হতাশা হয়ে ছোটা-ছুটি করল সমস্ত রাত। মনুও শানু ঘরামীর সঙ্গে গেলো।
গনি, ওসমান ও রাছেল বাড়িতে ফিরে আবুলের জননী গোলাপজান বিবি কাছে দুঃখজনক খবরটা দিলো। তখন আবুলের জননী গোলাপজান বিবি অবস্থা কেমন হলো-তা কারো বোঝার বাকি আছে ? আবুলের জননী গোলাপজান বিবি বারোং বার সাগরের কিনারায় গঙ্গামতির চরে যাওয়ার জন্য শতীর্থ প্রতিবেশীর কাছে আপত্তি করে বলল,
‘মোরে তোরা একটু চরে লইয়্যা ল মোর পোলাডারে দ্যাখমু’।
কিন্তু যাবে কেমনে ? জেলে ঘাটে কোন নৌকা নাই, সবাই মাছ ধরতে বের হয়েছে। ঘোর অন্ধকার নাই আলোর কোন ব্যবস্থা। গোলাপজান বিবি সারা রাত “আল্লা তুমি মোর পোডারে নিও না, হ্যার চাইতে মোরে লইয়্যা যাইও’। এভাবে কত কান্না-কাটি করল তার হিসাব মেলানো বড়ই মুশকিল।
রাখাল পাড়ার সকলের মধ্যে করুণ শোকের ছায়া বিরাজ করছিল বটে- শোক একটা নয় দু’টো। একদিকে যুয়ান আবুল গায়েল অন্যদিকে আবুলের অল্পদিন পূর্বে সাধি করা বৌ মিনারার কি হবে ? আবুল গত মাসের তের তারিখ হোসেন পাড়া গ্রামের নাসির প্যাদার পাঁচ নম্বর কন্যা মিনারারে সাধি করছে। মাত্র আঠারো দিনের মাথায় কন্যা স্বামীহারা হয়ে গেল। অল্প বয়সে আবুলের বিবাহের চিহৃ নাকফুলটা মিনারার ফুলতে হবে। কিছুদিন পরে হয়তো পড়নের লাল-নীল-হলুদ শাড়ীর পরিবর্তে এক রংয়ের শাড়ী পড়তে হবে। না যেন মেয়েটার কপালে কত দূর্ভোগ আছে। কারণ নাসির প্যাদা সামান্য একজন বুড়ো কাঠুরিয়া-ছয়টি কন্যা আল্লা তারে দিয়েছে। কোন মতে কষ্ট করে মিনারা সহ পাঁচটি কন্যা বিয়ে দিয়েছে। এখনো ঘরে একটি যোয়ান বিবাহের উপযুক্ত মেয়ে আছে। কেমন করে মিনারারে আবার বিবাহ দিবে ? তাছাড়া আবুলের কোন ভাই নাই যে তার সাথে সাধি হবে। আবুল গায়েল হওয়ার সংবাদটি এখনও মিনারার কানে পৌছেনি। সংবাদটি পাওয়ার পর মেয়ে কেমন করবে ? চিন্তাটা রাখাল পাড়ার বুড়োদের বিবেকের দরজা নাড়া দিলো। ভাবতে ভাবতে আচমকা গোলাপজান বিবির চোখে পরল, আংশুমালী পূর্ব অন্তরীক্ষে পুনরাগমন করার আগে যে তারকাটি আগমনী বার্তা নিয়ে ধরণীতে উদিয়মান হয়ে থাকে সেই নক্ষত্রটি পূর্বদিকে আনছার জোমাদ্দারের বাড়ির পুকুর পাড়ে বড় তালগাছটির উপরে। ধারণা করা হলো তমসা ঈষৎ সময়ের মধ্যে দূরীভূত হবে। সকলে গোলাপজান বিবিরে লয়ে জেলে ঘাটে যাওয়ার প্রস্তুতি গ্রহন করল। একটু পরে চলে গেল জেলে ঘাটে। চাঁনমিয়ার ছোট ডিঙ্গি নৌকায় চারজন গোলাপজান বিবি সহ গঙ্গামতির চরে। অজয় ধারায় শ্রাবনের বৃষ্টির মতো অশ্র“ বিসর্জন দিয়ে সাগরের কিনারায় কিনারায় খোঁজা-খুঁজি করল বটে- সন্ধান পাওয়া যায়নি। বেলা বারো টার দিকে গঙ্গামতির চর হতে মাইল পাঁচেক উজানে বাস্তহারা চরে আবুল মৃতদেহ ভেসে উঠল। সংবাদটি কে যেন গঙ্গামতি পৌছে দিলো।
দৌড়াতে দৌড়াতে চলে গেলো বাস্তহারার চরে সকলে। পাঁচ মাইল পথ কম তো না ? পৌছতে সময় তো ব্যয় হবেই। যাই হোক পোনে এক ঘন্টার মধ্যে পৌছে গেলো আবুলকে আনতে বটে- জীবিত না মরা। আবুলের লাশ সনাক্ত করার মতো উপায় ছিল না। পটকা মাছে শরীরের চামড়া চোখ খেয়ে ফেলছে। শেষে শরীরের গঠন আকৃতি দেখে সনাক্ত হলো। রাখার পাড়ায় এনে কোনমতে গোসল করিয়ে বেড়িবাঁধের পার্শ্বে বালুর ভিতরে দাফন করে দিলো-আদরের পোলা আবুলেরে। দিন দুই পর সকলের সহযোগীতায় একজন মৌলভী দাওয়াত করে এনে আবুলের জানের মাগফেরাত কামনা করা হলো। পুত্রহারা শানু ঘরামী মোনাজাত ধরে বলল, “হে আল্লা গো তুমি মোর বুকের মানিক ধন তোমারে সাগরে ইচ্ছা মতো পানি খাওয়াইয়া ডুবাইয়া মারছ, মুই টোকাইয়া আইন্যা এইহানে বালির মধ্যে থুইলাম তুমি হ্যাফাজত করিও”। (আমিন)
এদিকে জলোচ্ছ্বাসের জল চলে গেলো সাগরের বুকে। প্রকৃতি ধুয়ে-মুছে পরিস্কার করে দিয়েছে। রাস্তা-ঘাটে ও ধান ক্ষেতের জল আটকানোর বেড়ি হালকা-হালকা পলিমাটি জমে আছে। জঙ্গলের হিউজ পরিমান শুকনো পাতা-ফুল-ফল জলোচ্ছ্বসের জলে ভেসে অজানা ঠিকানায় পাড়ি দিয়ে চলে গেছে অদূরে। কৃষকের মনে আশার আলো নিভে যায়নি, ক্ষতি তেমন বেশী হয়নি। সপ্তাহখানেকের মতো খড়া থাকলে তেমন ক্ষতির সম্ভাবনা থাকবে না। নিচু জমির ধানের রোপন করা চারা গুলো জলের সাথে সাঁতার কাটছে। ভসমান হাঁসগুলো স্বস্তি পেয়েছে। মোট কথা প্রকৃতি স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। রাখাল পাড়ায় আবুলের দূর্ঘটনা ছাড়া আর কোন অপ্রতিকর ঘটনা ঘটে নাই।
আশ্বিন মাস শেষ হয়ে গেলো।
কার্তিক মাসের পহেলা প্রতি বৎসর গঙ্গামতি গ্রাম থেকে সোয়া দুই মাইল উত্তরে মিশ্রিপাড়া গ্রামে তিনদিন আদিবাসী রাখাইন উপজাতির ভার্মিজরা “ফানুস পূজা” উৎসব পালন করে থাকে। ফানুস পূজা মূলত আগুন, কেরোসিন ও পাতলা রঙ্গিন কাগজের খেলা। বাঁশের তিনটি চেড়া গোল করে গুনা দিয়ে বেঁধে একটি খাঁচা বানানো হয়। খাঁচার বাহির পার্শ্বে ময়দা গরম করে আটা তৈরী করে পাতলা রঙিন কাগজ লাগিয়ে চারপার্শ্বে আটকে দেয়া হয়, যাতে কোথাও কোন ছিদ্র না থাকে। মনে হয় গ্রাম্য গৃহে ধান,চাল,ডাল, কুড়ো ইত্যাদি মজুত রাখার পাত্র ডোলা তৈরী করেছে। ডোলার মতো একপাশ খোলা থাকে সেখানে গুনা আড়া-আড়ি ভাবে বেঁধে ঠিক মাঝখানে লম্বা আর একটি গুনা চার হাতের মতো নিচের দিকে ঝুলিয়ে দেয়, লম্বা গুনার মাথায় অনেকগুলো সূতির টুকরো কাপড় বেঁধে কেরোসিন দিয়ে ভিজিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়। আগুনের ধোয়ায় বানানো ডোলা বা ফানুস ফুলে এক পর্যায়ে উর্ধ্বঃগতি সম্পন্ন হয়ে হাত থেকে আসমানে উড়ে যায়। তখন রাখাইনরা ছোট ছোট হস্তবোমা ফাটিয়ে আনন্দে মাতিয়ে তোলে সমস্ত পল্লী। আরো ওদের ভাষায় কত কি যে কয় তা কে বোঝে ? ওদের আননের ভাষায় পাউনোজ বলে থাকে। দক্ষিণাঞ্চলের বেশ কয়েকটি রাখাইন পল্লী আছে, প্রত্যেক পল্লীতেই “ফানুস পূজা” উৎসব পালিত হয়। কোন পল্লীর ‘ফানুস’ কত বেশী আকাশে উঠবে সেই প্রতিযোগীতাও হয়। যে পাড়ার ‘ফানুস’ যত বেশী উপরে উঠবে তারা নাকি ‘ফারাতারার’ মঙ্গল লাভ করবে। সৃষ্টিকর্তাকে রাখাইনরা ‘ফারাতারা’ বলে। তিনদিনের এই ফানুস পূজা উৎসবে হরেক-রকমের পণ্যশালা বসে। মন্দির ঘরের চার পার্শ্বে আগত পণ্যশালাগুলো সারি বদ্ধভাবে বসিয়ে দেওয়া হয়। গঙ্গামতির আশে-পাশে যতগুলো রাখাইন পল্লী আছে তার মধ্যে ফানুস পূজা জম জমাট হয় এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে বড় মন্দির হিসেবে গৌরভ অর্জনকারী মিশ্রিপাড়া গ্রামে।
এবারের পূজা উৎসবে গরু-মহিষ নির্ধারিত জায়গায় রেখে সন্ধ্যার পরে ওরা চারজন রাখাল, আশে-পাশের গ্রামের কয়েকজন জেলে মিলে পূজা উৎসবে চলে গেলো। রাত্র একটা দু’টা বাজার পরে উৎসব শেষ হয়। সকলে নিজ নিজ গ্রামে ফিরে আসল। মনু রাতে পূজা থেকে ময়নার জন্য চার টাকা দিয়ে দুটো বেলুন কিনে আনছে। আর খাবার জন্য তিনটাকার আচার। অন্যরা মায়ের জন্য দশ টাকার পান-সুপারি আর বাবার জন্য আট টাকার তামাক কলকিতে খাওয়ার জন্য কিনে আনল।
বহুদিন গত হয়ে গেলো। ছন ভিটার ঘাস শেষ হয়ে গেছে। যা ছিল প্রচন্ড গরমে বালু উত্তপ্ত হয়ে ঝিমু ঝিমু করে মরে গেছে। গরু-মহিষের দল রুজির সন্ধানে গভির জঙ্গলে লতা-পাতা গিলতে প্রবেশ করেছে। গহিন জঙ্গলে থেকে গরু-মহিষ কোথায় যেতে পারে- সে ভয় রাখালদের মনে সব সময় কাজ করছে। তাই ওরা দলের প্রধান প্রধান ধেনুর গলায় কাঠের তৈরী ঘন্টা বেঁধে দিলো। ঘন্টা তৈরী করেছে একটি মাঝারি একফিট লম্বা নয় ইঞ্চি চওড়া কাঠ বাটল দিয়ে খোলসা করে ভিতরে চারটি শক্ত কাঠের ছোট ছোট বল্টু রশি দিয়ে ঝুলিয়ে। ওদের নিজ হাতে তৈরী ঘন্টা দু’মাথা দেখতে পাংশি নৌকার মতো- দু’মাথায় রশি বাধার মতো দু’টো ছিদ্র আছে। যার কারনে গবাদি পশুর দল জঙ্গলের ভিতরে হাটলে অবিকল কাঁশার ঘন্টার মতো শব্দ হয়। তফাতে শব্দ শুনে সনাক্ত করা যায়-গরু-মহিষের পাল কোথায় ? ওরা পাঁচজনের গরু-মহিষ চারজনে দেখাশুনা করছে। রাখাল দল ঘন্টা একটা নয়, দু’টো নয়, পাঁচটা নয়, চৌদ্দটির ধেনুর গলায় বেঁধে দিয়েছে।
মাস দেড় পর।
মনু হাজার খানেক মাহিনা পেলো। পহেলা মাহিনা পেয়ে একশত টাকা দিয়ে কেজি পাঁচে আড়াই প্যাঁচের জেলাপি কিনে মা-বাবার নামে, গ্রামের কয়েকজন মুরব্বী ও একজন মৌলভী আমন্ত্রন করে চাচা চাঁনমিয়ার পরামর্শ নিয়ে দোয়া মোনাজাত করে আশা প্রাপ্ত জান্নাতবাসী মা-বাবার রূহের মাগফেরাত কামনা করল। দু’টাকার আগর বাতি ও মোম বাতি কিনে মা-বাবার কবরের পার্শ্বে জ্বালিয়ে দিলো। আর ছোট বোন ময়নার জন্য নিজে পছন্দ করে একজোড়া সেলোয়ার কামিজ কিনে দিলো। লাল রঙের লুঙ্গি কিনল নিজে একখানা। বাকী টাকা সংসারের কাজে ব্যয় করল। আদর করে ময়নারে বলল, ‘ময়না মোর বোইন তর পছন্দ অইছে, তরে ভাল লাগবে আনে’।
-হ ভাইয়্যা।
দুই ভাই বোন খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ছিড়া ওগলায় পাতলা কাঁথা মুড়ো দিয়ে ঘুমিয়ে পরল। সকালে ঘুম থেকে জেগে গঙ্গামতির চরে গরু-মহিষ রাখতে চলে গেল। গরু-মহিষের পাল লতা-পাতা গিলতে জঙ্গলে যায়। রাখার দল হাড়কুচি কাটার উপর চিকন লতায় “শীতাফল” খোঁজ করতে করতে ভিতরে প্রবেশ করল। কিছু দূরে অগ্রসর হওয়ার পর জঙ্গলের গহিনে ছোট্ট একটি ‘হোতাখাল’ ভাটার শুকিয়ে গেছে। গাডালী-খোদা চিংড়ি মাছের মস্তের লাল লাল ছোচগুলো পানির উপরে জাগিয়ে খেলা ও আহার সংগ্রহ করছে। মাঝে মাঝে খোদার শ্যাওলা পরা বাঁকা পা-টা দেখা যাচ্ছে।
মনু, গনি, ওসমান ও রাছেল সবাই পড়নের ছোট ময়লা ধরা কাপড়টা কোমড়ের কাছে টোবার বানিয়ে চিংড়ি মাছ ধরতে আরাম্ভ করল। কত হাতাহাতি করল, কেওড়া গাছের শিকর থেকে মাটি ভেদ করে হুলার গোড়ায় ছোট ছোট কুচিয়া, কাঁকড়া, মিনুয়া ও দগরী মাছের তৈরী গর্তে, গাডালী চিংড়ি মাছ ভর্তি। এক একটি গর্তে দশ বারোটা চিংড়ি মাছ পাওয়া যায়। ওরা মাছ ধরে রাখবে খোথায় ? টোবরে আর সামলায় না। মনু নিজে বুদ্ধি করে হোতাখাল থেকে কূলে উঠে বড় একটি কেওড়া গাছে কুড়ালিয়া পাখির শক্ত ঠোট দিয়ে তৈরী পরিত্যাক্ত খোন্দলে টোবরের মাছ গুলো ভরে তাল-বেতাল গাছের একটি চওড়া পাতা ছিড়ে খোন্দলের মুখ ঢেকে রাখল। যাতে চিংড়ি মাছ ছিটে পড়তে না পারে। মনুর টোবরের মাছ না দেখে ওসমান বলে, ‘মনুন্যা তর টোহরের মাছ হরলি কি’ ?
মনু বলে, ‘কেওড়া গাছের খোসে থুইছি’।
মনুর কথা শুনে ওসমান একটা খোন্দল খোঁজ করে পেল, টিয়া পাখির পরিত্যাক্ত বাসা। চিহৃত করে মাছগুলো রাখল। রাছেল অন্য পদ্ধতি করে মাছ রাখল। ওর ধারনা গাছের খোন্দলে মাছ রাখলে হয়তো আর খোঁজ করে পাওয়া যাবে না। গহিন জঙ্গলে হাজার হাজার গাছ-সেকারণে রাছেল ও গনি হোতাখালের পার্শ্বে হালকা নরম কাঁদা মাটিতে হাতের আঙ্গুলী দ্বারা গর্ত করে মাছ রাখল আবার কাঁদা দিয়ে ঢেকে রাখল। ঘন্টা দুই মাছ ধরার পরে হোতাখালে জোয়ারের জল প্রবেশ করছে। মাছ আর পাওয়া যায় না। সবাই হোতাখাল হতে উঠে গায়ের কোড়তা খুলে কোন্দলের মাছ একাত্রিত করে গরু-মহিষ জঙ্গল থেকে বের করে পানি পান করিয়ে সাগরের নিকট মৌফল গাছের তলায় ছায়ায় রেখে গঙ্গামতির উজানে রাখাল পাড়ায় চলে আসল। মনু একটু তাফাৎ হতে ময়নারে ডাক দিয়ে বলল,
‘ময়না মোর কলিজার টুকরা বোইন জলদি আকটা পাইলা লইয়্যা আয়’।
ময়না ভাইয়ের ডাকে সারা দিয়ে একটি পাতিল নিয়ে উঠানে নেমে মাছ দেখে খুশি হয়ে বলে,
‘আইজগো মুই কইলাম দুগগ্যা ভাত বেশি খামু’।
মনু বোনের আকুতি শুনে বলে, ‘ক্যান বোইন ক্যান তুই ওকতা কইলি ? তরে কোন দিন কম খাইতে কইছি’?
ময়না বলে, ‘না ভাইয়্যা কওনাই, মুই এমনেতেই কইছি’।
মনু বলে, তুই চাচারে বোলান দে’।
ময়না আপত্তি করে বলল, ‘ভাইয়্যা তুমি দেওনা’?
তারপর মনু নিজেই চাচা চাঁনমিয়ারে ডেকে অর্ধেক মাছ দিয়ে দিলো। চাঁনমিয়া তো খুশি হয়ে নিয়ে গেলো কুটিরে। ময়নার সাথে মনু মাছ কুটিতে আরাম্ভ করল। মাছ কোটা শেষ করে নতুন কেনা কাপড়টা কাঁধে লয়ে রাস্তার পার্শ্বে ডোবায় গোসল করতে চলে গেলো। কুড়ের ঘরে ফিরে এসে খেজুর পাতার ছিড়া হোগলাটা কুটিরের মেঝেতে বিছিয়ে দুই ভাই বোন টিনের থালায় ভাত নিয়ে মনমত খেয়ে পেট যশোরের খেজুর গাছে নির্যাসের পাতা হাড়ির মতো গোল করল। এখন মনুর শ্বাস টানতে কষ্ট হচ্ছে। ময়না ভাইয়ের মাথার পাশে বসে যন্ত্র করে মাথায় হাত দিয়ে বলে, ‘ভাইয়্যা একখান কতা কইতাম রাগ অবা নি’?
মনু বলে, ‘ক্যান রাগ অমু তুই মোর বোইন না’।
ময়না বলে, ‘তুমি অহন একটা মোর লইগ্যা ভাবি আইন্যা দেও’।
মনু আননের সবকয়টা দাঁত বের করে হাসি দিয়ে বলে, ‘আ......রে পাগলি বোইন মোর মুই ভাবি আমু না, হ্যার চাইয়্যা একটা দুলাভাই আনি ক্যান ’?
ছোট ময়না শরম পেয়ে ঘর থেকে সোজা চাচার ঘরে ঝামেলা বিবির দ্বারে গিয়ে-মাথার চুলের পোকা বাছার জন্য বসে পরল। কিছুক্ষণ পরে মনু বিছানা থেকে উঠে ময়নারে ডাক দিয়ে বলল, ‘মুই গঙ্গামতি যাই’।
ময়না সায় দিয়ে বলে, ‘হহালে বাড়ি আইও’।
মনু ও ওসমান গঙ্গামতির চরে চলে গেল। গনি-রাছেল তখনও চরে যায়নি। গরু-মহিষ জঙ্গলের গহিনে ডুকে গেছে। কুড়া কুড়া বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। আসমান মেঘাচ্ছন্ন ছিল না। কোথা থেকে আচমকা এক খন্ড মেঘ উঠে এসে বৃষ্টি বর্শন করতে শুরু করল। বৃষ্টির মাঝে চড়া রোদ- রাখালদের ধারণা পাতিশিগালের বিয়ে হচ্ছে। ওরা দু’জন ঝোপের আড়ালে দাঁড়িয়ে ভাবছে- গরু-মহিষ কোথায় যেতে পারে ? এর মধ্যেই গনি ও রাছেল গীত গাইতে গাইতে ভিজা বালুর চরে আস্তে আস্তে হাতের লাঠিটা ঘুড়াতে ড়–ড়াতে দুষ্টামির ছলে আসতেছে জঙ্গলের দিকে চোখ রেখে। মনু-ওসমান ঝোপের আড়াল থেকে বের হয়ে চারজন একসঙ্গে জঙ্গলের কিনারায় চলে গেলো। কিন্তু গরু-মহিষের পালের প্রধান ধেনুর গলায় ঝুলানো ঘন্টার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না। এমনকি শুকনো পাতায় ধেনুর পা রাখার মচ মচ শব্দও শোনা যাচ্ছে না। মনুর ধারণা হয়ত ঈষৎ তফাতে বাইন বিটপী কাননে যেতে পারে। সবাই একত্রে বাইন বিটপীর কাননের দিকে অগ্রসর হলো। কিছুদুর অগ্রসর হওয়ার পরে ভিন্ন ভিন্ন আওয়াজ শোনা গেল। বাইন বিটপী কানন বটে- অন্য কোন গাছ নেই তা নয়। বাইনের সংখ্যাই বেশী। বড় গরু-মহিষ যখন জঙ্গলের গহিনে লতা-পাতা খেতে প্রবেশ করে তখন বাছুর গুলো জঙ্গলের পার্শ্বের ছনবিহীন শুন্য ভিটায় জঙ্গলের পানে মুখ করে হাম্বা-হাম্বা অবিরাম ডাকতে থাকে। এদিক-সেদিক ছুটা-ছুটি করা থেকে বিরত থাকে না।
সন্ধ্যার আগে গরু-মহিষের দল বন হতে খোলা আসমানের নিচে বিস্তীর্ন ছনবিহীন খালি মাঠে বের করল। গরুগুলোকে আগে পথ দেখিয়ে মহিষগুলো গরুর পাছায় রেখে চারজনে চারটা বড় মহিষের পিঠে উঠে আস্তে আস্তে হাতির সোভা যাত্রার মতো সামনে আগাতে আরাম্ভ করল। মনু যে বলী মহিষটার পিঠে উঠে মাঝে মাঝে পথ চলত সেটার নামে রেখেছে “উদিয়া”। মনু মহিষটাকে উদিয়া বলে ডাকে। উদিয়া মহিষটা মনুর কথাও শোনে। মনু যখন বলে, ‘উদিয়া ছ্যালুট দে’।
তখন উদিয়া নামের মহিষটা সামনের হাটু বাজ করে মাটিতে রেখে মাথা নত করে থাকে। যতক্ষনে মনু ‘উদিয়া ওঠ’ না বলে ততক্ষনে মাথা জাগায় না। কিন্তু যখন উদিয়ার গায়ে রাগ থাকে তখন লম্বা কোকড়ানো শিং দুটো এলো পাতালি ভাবে নাড়াতে থাকে।
মনুর মতো মনুর বন্ধুরাও এক একজনে এক একটা নাম রেখেছে- ওদের কথা শোনে না এখনও। তাই ওরা রাগ করে হাতের পাচনটা দিয়ে সায়েস্তা করতে আরাম্ভ করল। মনু ওদের বারণ করে বলে,‘এইয়্যার লইগ্যাই তোগো কতা হোনে না’।
ওরা বলে, ‘কতা হোনে না ক্যান’ ?
মনু বলে, ‘পিটা পিটি করিস না কয়দিন গ্যালে হোনবে আনে’।
ওরা আঘাত করা থেকে বিরত থেকে যথাস্থানে গরু-মহিষ রেখে চলে আসল রাখাল পাড়ায়।
রাছেল বজ্জাতটার একটা খারাপ অভ্যাস আছে। বাছুর প্রসব করা গাভীর দুধ ভর্তি স্তনের বোটা মুখে নিয়ে বাছুরের মতো দুধ খেতে দ্বিধাবোধ করে না। প্রত্যেক দিনের অভ্যাস। মনু, ওসমান ও গনি মাঝে মাঝে হাসি-ঠাট্টা করে গড়া-গড়ি খেত। ওরা ওকে রাছেল না বলে বাছুর বলে ডাকে। মাঝে মধ্যে রাছেল রাগ হয়ে বলে, ‘তরা বাছুর কবিনা কইলাম’। সন্ধ্যার একটু পরে যে যার ঘরে চলে গেলো। মনু বাড়ি ফিরে ঘরে আসা মাত্র ময়না একটা দুঃসংবাদ দিয়ে বলে,
‘মোগো যে মুরাডায় দুই গোন্ডা আন্ডা পারছে, আরো দুই গোন্ডা আন্ডা পাইর্যা উমান বইবে, হেই মুরাডারে পাতিহালে লইয়্যা গ্যাছে’।
মনু চার আঙ্গুল অলিকের উপর হাত দিয়ে ‘হায় হায় কি সোমবাদ হুনাইলি ময়না’।
কোনদিকে নিয়ে গেছে জানতে চায়। ময়না বলে, ‘সন্ধ্যার একটু আগে জোঙ্গলের দিকে লইয়্যা গ্যাছে’।
মনু কি আর করবে ? উপর ওয়ালার প্রতি কম গোসা হয় নাই। চুপ-চাপ বসে রইল। ময়না ভাত রেডি করে ডাক দিলো। মনু ছিড়া হোগলাটায় হাটু বাজ করে বসল মূর্তি বসানো ভঙ্গিতে। ময়না টিনের খাড়া থালে ভাত দিলো, ভাত ভর্তি থালের পাশে চিংড়ি মাছের ভর্তা। খাওয়া শেষ করে ছোট বোন ময়নারে লয়ে গেওড়া কচার পাতানো মাচায় শুয়ে পরল বটে-তবুও ঘুমাতে পাড়ল না। মশার কামড়ে অস্তির, ভাল মশারি নাই। বাগদা চিংড়ি মাছের পোনা ধরার পুরানো নেট জাল দ্বারা মনুর মা- শরভানু সুই-সুতা দিয়ে একটি মশারি তৈরী করেছিল। সেটা এখন বয়জা হয়ে গেছে। মশার ভিতরে ডুকতে-বের হতে কষ্ট হয় না। সমস্ত রাত্র মশা তাড়াল মনুর হাতের তালগাছের আস্তা ডগা দিয়ে বানানো পাখার দ্বারা। ময়নার ঘুমাতে কষ্ট হয়নি বটে-কিন্তু মনু মোটেও ঘুমাতে পারেনি। শেষ রাতে মনুর চোখ আমনে আমনে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বটে- কিন্তু মশারা ফাঁক পেলেই মনুর নাকের ডগায় একটা দুইটা কামড় দেয়।
মনু অতিষ্ট হয়ে বলে, ‘হালার মাশা মোগো গেরামে চাওকি ? ঐ ধনী গেরামে যা পেট ভইর্যা খাইতে পারবি, যা... গেলি..... জ্বালাইস না’।
---------------*******-----------
No comments