গঙ্গামতির রাখাল-(পর্ব-তিন)
গঙ্গামতির রাখাল-(পর্ব-তিন)
Novel Cover Photo
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে মনু ভাবছে সামনে অগ্রহায়ন মাসের পূর্ণিমা। এ পূর্ণিমায় হিন্দু সম্প্রদায়ের পূজা উৎসব। আর অগ্রহায়ন মাসের পূজা ‘রাস’ উৎসব নামে পরিচিত। রাস পূর্ণিমায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল হতে হাজার হাজার হিন্দুর আগমন ঘটে। অন্য সম্প্রদায়ের লোকজন জমায়েত হয় না তা নয় বটে- তবে পূজো করতে না উপভোগ করতে, কিছু কেনা কাটা করতে। রাস পূর্ণিমার মেলা সাজানো হয় পরিচ্ছন্নভাবে। গঙ্গার পাড়ে স্যাঁতস্যাঁতে বালুর বুকে বসানো হয় বিভিন্ন পণ্যশালা গুলো। মহাসড়কের পশ্চিম পার্শ্বে বসানো হয় ক্যাম্পচারের মজমা। কেউ কবিরাজী ঔষধ, কেউ তাবিজ মাধলী, কেউ বোনাজি লতা-পাতা, কেউ আবার শ্রীপুরের ট্যাবলেট বিক্রি করে মাইক বাজিয়ে। ছোট ছোট মেয়ে শিল্পী দিয়ে গান পরিবেশন করে। রাস্তার পূর্ব পার্শ্বে ফয়েজ মিয়ার নারিকেল বাগানের ফাঁকে তিন বিঘা জায়গায় ছোট-বড়-মাঝারি অনেক গুলো মূর্তি বসিয়ে পূর্বদিকে মুখ করে দুইহস্ত জোড়া প্রনাম করে হিন্দু সম্প্রদায়ের সকল গোত্রের লোকজন। অন্য পার্শ্বে মুসলীম জাতির মাহফিলের প্যান্ডেলের মতো করে হিন্দুদের ধর্মীয় গুরু ঠাকুর ওদের ধর্মীয় গ্রন্থ গীতাপাঠে জ্ঞান দিবেন। তার মানে এই না যে, ওরা গীতা পাঠ শ্রবন করার জন্য আগমন করেছে। ওদের আসল উদ্দেশ্য “গঙ্গাস্নান”। গঙ্গার জলে নেমে ঊষাকালের পূর্ব মুহূর্তে স্নান করে পাপ মোছন করবে। আননে লম্বা লম্বা গোফ ওয়ালা সাধুরা শ্বেত ধূতি এগারো হাত পড়নে, গায়ে পোশাক বিহীন গলায় পৈতার মালা, হাতে উদরক্ষ মালা, কারো হাতে আইচার মালা, কারো হাতে তুলশির মালা, কারো হাতে বেলের মালা লয়ে শ্রী শ্রী লোকনাথ ব্রক্ষচারীর আসনের মতো হাটু বাঁকা করে বসে ধ্যানে মগ্ন থাকে। পার্শ্বে মাটির হাড়ি বোঝাই জল, কচি নারিকেল থাকবে বটে- কে যানে কি করবে? কুয়াকাটা চৌরাস্তার পূর্ব পার্শ্বে রাখাইন উপজাতির ধর্মালয়ে পিতল প্রলেব মূতি। দর্শন করার জন্য লোকের আনাগোনা। একজন দারোয়ান তো আছেই বটে-পাদুকা নিয়ে প্রবেশ ঠেকানোর জন্য। মন্দির ঘরের নাম “শ্রী মঙ্গল বৌদ্ধ বিহার”। এর পাশেই বিস্তর বড়ো ছায়াদানকারী বটবৃক্ষ। বটবৃক্ষের তলায় শত শত হিন্দু নারী শুয়ে বসে আছে, কঁচিকাঁচা বাচ্চাদের নিয়ে।
মনু কোন দিন রাস উৎসবে যেতে পারে নাই। লোকের মুখে শুনেছে মেলার বিবরণ। ওসমান, গনি ও রাছেল রাস পূর্ণিমার পূজার মেলার যাবে। কিন্তু মনু যাবে কিভাবে ? হাতে টাকা পয়সা নাই। ওরা সবাই যাবে মনুর যাবার খায়েস আছে। তাই কিছুক্ষণ ভাবতে ভাবতে একটি উপায় খুঁজে পেয়েছে। নিজের রাখ্খালি রাখা গরু-মহিষের মালিক খালেক প্যাদার নিকট থেকে কিছু টাকা এনে রাখাল বন্ধুদের সাথে হিন্দু সম্প্রদায়ের “গঙ্গাস্নান উৎসবে” যাবে। বেশী দিন বাকী নাই আর মাত্র তিন দিন বাকী।
মনু কোন দিন রাস উৎসবে যেতে পারে নাই। লোকের মুখে শুনেছে মেলার বিবরণ। ওসমান, গনি ও রাছেল রাস পূর্ণিমার পূজার মেলার যাবে। কিন্তু মনু যাবে কিভাবে ? হাতে টাকা পয়সা নাই। ওরা সবাই যাবে মনুর যাবার খায়েস আছে। তাই কিছুক্ষণ ভাবতে ভাবতে একটি উপায় খুঁজে পেয়েছে। নিজের রাখ্খালি রাখা গরু-মহিষের মালিক খালেক প্যাদার নিকট থেকে কিছু টাকা এনে রাখাল বন্ধুদের সাথে হিন্দু সম্প্রদায়ের “গঙ্গাস্নান উৎসবে” যাবে। বেশী দিন বাকী নাই আর মাত্র তিন দিন বাকী।
দুপুর বেলা চর থেকে এসে গোসলের আগে খালেক প্যাদার নিবাসে চলে গেলো। খালেক প্যাদার সাথে টাকার ব্যাপারে কথা বলল। প্যাদা জিজ্ঞাসা করল কত টাকার দরকার। মনু দুইশত টাকার বেশী চাইল না। খালেক প্যাদা বলে দিল আগামীকাল একই সময় যাইতে। আজ প্যাদার নিকট টাকা নেই। টাকা পাওয়ার আশা নিয়ে ফিরে আসল রাখাল পাড়ায়। পরের দিন মাতন্ড ঠিক মস্তের উপর। মনু চলে গেল মহাজনের বাড়ি। খালেক প্যাদা দুইশত টাকা দিয়ে দিলো। মনু আননে একটা হাসি দিলো বটে- ফুটিয়ে নয় চাপা হাসি। টাকা নিয়ে আনন্দে চলে আসল গন্তব্যে। ময়নারে বলে দিলো আগামীকাল সন্ধ্যা রাত্রে “গঙ্গাস্নান উৎসবে” যাবে ময়নার কি কি দরকার। ময়না মনু যা পছন্দ করে কিনে আনবে তাতেই খুশি হবে বলে দিলো।
একদিন পরে সন্ধ্যা রাত্রে ওরা চারজন সাথে আরো চার পাঁচজন একাত্রিত হয়ে সাগরের ভিজা ভিজা বালুতে পদ দিয়া পা পা করে হাটি হাটি রহনা হলো। কিছু দুর অগ্রসর হবার পরে ওসমান বলল, মনুরে উদ্দেশ্য করে- ‘মনুন্যা তুই একটা গীত কয় তো’।
কোন গীত ?
ওসমান বলে, ‘তর যেইডা ভাল লাগে হ্যাইডা কয়’।
কিছু সময় চুপ থেকে গলায় চাপা কাঁশি দিয়ে ডোগ গিলে গাওয়া আরাম্ভ করল, শোনা গান নকল করে।
মোরা গঙ্গামতির রাখাল, মোগো মেজাজ বোলে কড়া
হক্কলডি মিলল্যা কয়,
আদর আস্তিক ভালই জানি কথা
হেইডা মিথ্যা নয়।
সাগর পাড়ে বাড়ি মোগো-
বন্যা ঝড়ে নিত্য,
ভাসাইয়া নেয় যা কিছু আছে-
বাপ দাদারই বিত্ত।
আদর আস্তিক ভালই জানি কথা
হেইডা মিথ্যা নয়।
মোরা যারে ভাল ঠেহি
পরান হালাই দিয়া,
দোষের মধ্যে একটা আছে
বেশি হরি বিয়া।
হেইতে মোগো বদনাম রটে-
মানুষ মোরা মোন্দ নয়,
আদর আস্তিক ভালই জানি কথা
হেইডা মিথ্যা নয়।
মনুর গানটা শুনে দুহাতে করতালী দিয়ে অভিনন্দন জানাতে ভুল করল না রাখাল দল।
ময়নার জন্য মনু মেলা থেকে প্রধান আকর্ষন দশ টাকা দিয়ে দুইছড়া ঝিণুক মালা ও চুল লম্বা করার জন্য বিশ টাকা দিয়ে একটি তাবিজ কিনে আনল। আসলে কেশ লম্বা হবে কিনা মনু জানে না। না উনারা ভন্ডামী করল নাকি ধোকা দিয়ে টাকা নিল নানা প্রশ্ন। নিজে দশ টাকার একটি সরু নলি বাঁশের তৈরী বাঁশি কিনে আসল। আর চাচাতো ভাই সাজু ও মজুর জন্য দশ টাকার কয়েকটি ফুলানো বেলুন কিনে আনল। নিজে রাত্রে দু’টাকা বাদাম ভাজা, ঝাঁলমুড়ি, আইসক্রীম মোট বারো টাকা খেয়েছে। পাঁচ টাকা দিয়ে লটারী ধরছিল বটে- পেয়েছে মেয়েদের চুল বাধার ফিতা। হাসি মুখে মনু ট্যাংরে নিয়ে আনল। মনুর দেখা-দেখি ওসমান,গনি ও রাছেল একটা করে বাঁশের বাঁশি, বাবার জন্য পাঁচ টাকা তামাক, মায়ের জন্য কোমড় ব্যাথার দশ টাকা দিয়ে সালসা এবং কবিরাজ হোসেন মোল্লার দুটা নিমের মাজন কিনে আনল। ফুলানো বেলুন সকলের হাতে তো আছেই।
সমস্ত রাত্র “গঙ্গাস্নানাৎসব” পূজার মেলা উপভোগ করে প্রাতঃকালে বাড়ি ফেরার পথে কয়েকটা এক টাকা দামের ঢাকা টোবাকো কোম্পানীর নেভী সিগারেট কিনে টানতে টানতে, তালবিহীন বাঁশির বাজাতে বাজাতে, হাতের ফুলানো বেলুনের খস খস শব্দ করে গঙ্গামতির রাখায় পাড়ায় চলে আসল। যার জন্য যা রাস উৎসব থেকে কিনে আনছে মিট মাট করে বিলি করে দিয়ে দিলো। ওরা টাকা সব খরচ করে নাই। মেলা একদিন না তিন দিন। মাঝের রাত ঘুমাতে হবে শেষের রাতে আবার যাবে। সুবিধা আছে গাড়ী-গোড়ার পথ না টাকা তোন কমই খরচ হবে। মনুর একটু ভয় করেছে। কারন মেলার আইন শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য দেশের সরকার অসংখ্য পুলিশ, আনসার, বিডিপি, বিডিআর, সেনাবাহিনী, যৌথবাহিনী ও র্যাব মোতায়েন করেছে। ওসমান মনুরে অভয় দিয়ে বলে-
‘মোগো ডর কির লইগ্যা- মোগো হরবে কি ? মোরা চুরি করমু না, ডাহাতি করমু না, আতা-আতি করমু না, মোরা খালি দ্যাকমু ”।
একদিন পর।
সন্ধ্যায় পুনরায় মেলায় চলে গেল রাখালরা। এদিক-সেদিক ঘুরে ঘুরে দেখছে। কিন্তু মনুর ঘোরা-ঘুরির চেয়ে ক্যাম্পচারের সত্য-মিথ্যা মিশানো লেকচার শুনতে আরাম লাগে। অন্য কোথায় যেতে চায় না। ওসমান, গনি ও রাছেল মনুরে শ্রীপুরী ট্যাবলেট বিক্রেতার নিকট মজমায় রেখে গীতা পাঠের আসরে চলে গেল। একটু পরে ওরে মা, ওরে বাবা চিৎকারের শব্দ আর ঠাস ঠাস লাঠির পিটানোর শব্দ কানে ভেসে আসল ওদের। ওরা ভয়তে সেখানে যায় নাই। পরে ছড়া-ছড়ি হলো দু’টো অসভ্য যুবক হিন্দু সম্প্রদায়ের যুবতি মেয়ের কানের গহনা ধরে টান দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে পাবলিক ধরে ডিউটিরত সেনাবাহিনীর হাতে সোপর্দ করেছে। আচ্ছা মতন সায়েস্তা করে কুয়াকাটা নৌ-পুলিশ ফাঁড়িতে আটকে রেখেছে। আরো ছোট ছোট ঘটনা কম ঘটেনি শেষ রাতে। ওরা তিনজন মনুর নিকট পৌছে মনুরে নিয়ে ঊষাকালে সবাই ধীরে ধীরে রাখাল পাড়ার উদ্দেশ্যে রহনা হলো। কারো মুখ খালি নাই-হাতে তো সিগারেট আছেই। আউলা-জাউলা পাঁচমিশালি গান সে যেখান থেকে পারে তো গায়। গান তো না বড়ো দুষ্টামী। আবার মনু শ্রীপুরের ঔষধ বিক্রির লেকচারও দেয়। গনি গীতা পাঠ করে বেঙ্গসুরে, ‘ও.... হ শান্তি ও...হ শান্তি, ও....হ শান্তি। যে যা আয়ত্ব করেছে তা বলছে। আর সাগরের পাড়ে ভিজা বালুতে হাজার হাজার লাল কাঁকড়া ধাওয়াতে ধাওয়াতে দুষ্টামির ছলে গঙ্গামতির রাখাল পাড়ায় ছন, ন্যাড়া ও হ্যাতাল পাতার ছাউনী বসতি ঘরে ফিরে আসল রাস মেলা থেকে। সবাই পান্তাপানি খেয়ে চলে গেল গঙ্গামতির চরে গরু-মহিষ চড়াতে।
সপ্তাহখানেক পরের কথা। মনু মস্ত বড়ো চিন্তায় পড়ে গেল। গরু-মহিষ রাখার মরশুম প্রায় শেষ প্রান্তে। ইতিমধ্যে খালেক প্যাদার দু’জোড়া মহিষ ফেরৎ নিয়ে গেছে। রবিশষ্য ক্ষেতে হাল-চাষ করার জন্য, ধীরে ধীরে সকলে গরু-মহিষ ফেরৎ নিয়ে যাবে। মহাজনরা মাঠ হতে ধান ঘরে তুলতে আরাম্ভ করেছে। ফসলের মাঠ শুন্য হয়ে গেলেই বিলে গরু-মহিষের খাদ্য মিলবে। তাছাড়া জঙ্গলে তেমন বেশি ঘাস নাই। লতা-পাতাও নাই। কিভাবে চলবে দুই ভাই বোনের ছোট সংসার। এ যেন ছোট মাথায় পাহাড় সমান চিন্তা। মনুর মতো অন্য রাখালদের চিন্তার কমতি আছে। বাবা-মা বেঁচে থাকায় তাদের সংসারের চিন্তা নেই। চিন্তা বাবা-মার, ওদের নয়। ওরা যা আয় উপার্জন করবে তা বোনাজ। তারপরও অভাবি সংসার, নিত্য অভাবের সাথে যুদ্ধ করতে হয়। ‘অভাব গঙ্গামতির রাখাল পাড়ায় স্থায়ী বসতি স্থাপন করেছে, অন্য পাড়ায় ঠাঁই পায় না’।
মনু গাছ তলায় বসে ভাবছে, মাথা হেও করে হাটুর ফাঁকে রেখে। ওসমান জিজ্ঞাসা করে, ‘মনু ওরকমের বইয়্যা রইছো ক্যানো’ ?
মনুর মাথার উপর চেপে পরা চিন্তার কথা বলে দিলো। ওসমান বরে, ‘চিন্তা হরিস না, মোরা তোরে লইয়্যা সাগরের পোনা ধরমু’।
মনু পোন কিরবে কিভাবে ?
বাগদা চিংড়ির পোনা ধরতে হলে জাল,দরি ও অন্যান্য অনুষাঙ্গিক জিনিস পত্র কিনতে কমছে কম দেড় হাজার টাকা লাগবে। অথচ পোনা ধরতে আড়ৎদাররা দাদন দিয়ে থাকে। কিন্তু মনু বয়সে কচি, দাদন দিবে কে ? তাছাড়া দাদন টাকা হাতে নিলেই ঝামেলা ঠিকমত দাম পাওয়া যায় না। আড়ৎদাররা শোষন করে খাবে ওদের সমস্ত দিন-রাতের পারিশ্রমিক। আপন আপন চিন্তা করল কোন দিন পোনা ধরে নাই। সাগরের পাহাড় সমতুল্য উর্মির সাথে যুদ্ধ করে পারবে না। আর একটা ভয় তো আছেই, হারানো রাখাল আবুলের মৃত্যু। এ সবকিছু চুপ-চাপ চিন্তা করে বলল, ‘না ওসমান ভাই মুই পারমু না, হারামজাদা সাগরে পোনা ধরতে’ ।
ওসমান গোসা হয়ে বলে, ‘তুই পারবিডা কি’?
মনু বলে, ‘হ্যা মুই জানি না, দেহি না চাচায় কি কয়’ ?
ভাবতে ভাবতে অগ্রহায়ন মাস গত হয়ে গেলো। মহাজনরা গরু-মহিষ ফেরৎ নিয়ে গেছে নিজের বাড়িতে সকল মহাজন মাহিনা পরিশোধ করে। মনু মাহিনা টাকা দিয়ে পনের দিনের চাউল,ডাল ও অন্যান্য সওগায় কিনে আনল ঘরে।
একদিন পর।
চাচা চাঁনমিয়ার নিকট জিজ্ঞাসা করল এখন কি করবে ? চাঁনমিয়া ভেবে দেখবে বলে দিলো। এমন মুর্হূতে চাঁনমিয়ার বউ ঝামেলা বিবি কোথা থেকে এসে বলে, ‘হাশেম জোমাদ্দার তরমুজ ক্ষেতে কাম করার জন্য, একটা পোলা মাসঠিয়া কামে রাখবে’।
চাঁনমিয়া বলে, ‘মনু পারবে না তরমুজ ক্ষেতে কাম হরতে’।
মনু বলে, ‘পারমু না ক্যান, পারমু না তয় খামু কি ’?
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে চাঁনমিয়া হাসেম জোমাদ্দার বাড়ি চলে গেল। হাসেম জোমাদ্দার বলে দিলো, মনু কাজ করতে পারলে তার কোন আপত্তি থাকবে না। চাঁনমিয়া বেতন ঠিক করল মাসে পাঁচশত টাকা। আগামী পরশু দিন কাজে যোগদান করতে হবে। চাঁনমিয়া আবাসনে ফিরে আসল। মনু জিজ্ঞাসা করার আগে চাঁনমিয়া বলে দিলো পাঁচশত টাকা বেতনে কাজ ঠিক হয়ে গেছে। মনু একটু স্বস্তি অনুভব করল। দিন দুই অবসরে থেকে হাসেম জোমাদ্দারের বাড়ি চলে গেল। কাজে ভর্তি হয়ে গেলো। সমস্ত দিন কাজ করে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে আসল। হাসেম জোমাদ্দার ভাল মানুষ মনুর তার সাথে কাজ করতে কষ্ট হবে না মোটেও। অল্প কয়দিন কাজ করেই মনু তা অনুভব করছে। একদিন মনু হাসেম জোমাদ্দারকে বলল, ‘চাচা মুই বর্ষা হালেও আপনার লগে কাজ করমু’।
হাসেম জোমাদ্দার এর বুঝতে বাকী থাকল না মনু তাকে ছেড়ে যেতে চায় না কেন ?
হাসেম জোমাদ্দার বলে, ‘বর্ষার দানদা পরে আগে দুলাড খ্যান্ত হইয়া লউক’।
মনু আত্মবিশ্বাসী হলো। মনের ফুর্তিতে অনেক দিন কাজ করল।
হাসেম জোমাদ্দারের কন্যা রেনু একটা আস্তা খবিস। মনু উত্তপ্ত রৌদে তরমুজ ক্ষেতে মস্তকের তালু হতে ঘাম জড়িয়ে পদতলে ফেলে মরুভূমি নয় বটে- মরুভূমির চেয়ে কম না মোটেও। বালু এত বেশী উত্তপ্ত হয় যে, চাউল দিলে উরুম ফুটবে। পাইজাম ধান লাখলেই খই হবে সন্দেহ নাই। হাড়ভাঙ্গা কাজ করে দুপুরের খাবার খেতে বাড়ি আসলেই বিবিধ কাজ পেতে রাখে। মনু পারবে না বললেই, খবিসটার চক্ষু রঞ্চিত ও আনন এত বেশী মলিন হয় যে দেখলে মনে হবে, এই মুহূর্তে প্রকান্ড একটা ঘূর্ণিঝড় হাসেম জোমাদ্দারের বাড়ির উপর দিয়ে বয়ে গেছে। রেনুর মা চাতুরি বেগম উপরে উপরে মিঠা কথা কয় ভালই-মনের মধ্যে রেনুর মতই। প্রকাশ করে না- হাসেম জোমাদ্দারের পয়জা পিটার ভয়ে। হাসেম জোমাদ্দার ছোট খাটো দোষ পেলেই চাতুরী বেগমের ওষ্ঠে-মুষ্ঠে-পিষ্ঠে পয়জা পিটা দিতে দ্বিধাবোধ করে না। চাতুরী ও রেনুর পরোয়া মনু করবে কেন ? মনু হাসেম জোমাদ্দারের কার্যপুত্র। হাসেম জোমাদ্দার যা বলেন তা করবে আপাতত আর কোন ধ্যান নাই।
মনুর বিরামহীন, অলস্যবিহীন পরিশ্রমের জন্য তরমুজ ফলল হিউজ পরিমান। দামও মন্দ পেলো না, হাজার ত্রিশে মুনফা পেলো। হাসেম জোমাদ্দার পাঁচশত টাকা বেতন বোনাজ দিলো। মনু অতিরিক্ত পাঁচশত টাকা পেয়ে ফুর্তিতে একলা একলা গান ধরল,
গঙ্গামতি আছে বাইসব হাজার তরমুজ চাষী,
সমস্ত দিন কষ্ট তবু, মুখে মিষ্টি হাসি।
কলসি ভরে পানি টাইন্যা থ্যানার মধ্যে দিলাম ডেলে,
থ্যানার পানি লতার মাথায় ফলের মধ্যে ক্যমন করে গেলে ?
তরমুজ বেইচা মহাজনে পাঁচশত টাকা দিছে বেশী
আডে যাইয়্যা ছাগল কিনমু, আরো কিনমু বাঁশি।
ছাগল বানমু রাস্তার পাশে ঘাস খাইবে পেট ভরে
বাঁশি বাজামু পাড়া ঘেসে তাল-বেতাল সুরে।
আর পারে না এটুকু বারোং বার গাইতে গাইতে বাড়ি ফিরে আসল।
বিকালে গঙ্গামতির চরে সাগর পাড়ে চলে গেলো। ওসমান, গনি, রাছেল পোনা মাছ ধরার জন্য দেয়া ছনের ছাউনী গেওড়া কচার মাচন পাতা বাসায়। ওরা গাছের নিচে বালুর উপর জেগে থাকা শিকড়ে বসে বিড়ি টানছে মজা করে।
মনু পিছন থেকে ডর দিয়ে বলে, ‘মোরে একটা বিড়ি দে তো দেহি’।
ওসমান পানজা বিড়ির মোচাটা কোছা থেকে বের করে একটা আস্তা বিড়ি দিল। গনি রাজধানী নামের দিয়াশলাই মনুর হাতে দিলো। মনু বিড়িটা জ্বালিয়ে টানতে টানতে জিজ্ঞাসা করে, ‘তরা পোনা পাইলি-টাইলি কেমন’?
ওসমান বলে, ‘না সুবিধা না, খাইয়্যা পইর্যা থাকতেই মুশকিল হইত্যাছে। একদিন পাইলে হাত দিন পাই না’।
রাছেল বলে, ‘মনুন্যা তোর পালা-পদ্ধ কি হ্যাইডা কয়’।
মনু বলে, ‘ভাল। মন্দ না। মহাজন পাঁচ’শ টাহা বেশি দিছে, বর্ষা হালেও হের লগে থাহুম’।
ওসমান বলে, ‘হেলে তো দেখছি তোর মহাজন ভাল মানুষ’।
মনু বলে, ‘মহাজন ভাল, হেরপরও ভাল। তবে মাইয়া রেনুন্যা আস্তা খবিস, একটার পর একটা কাম পাত্যাই থোয়। মোডে জিরাইতে দিতে চায় না ছ্যামরী অচেল অচেল খবিস’।
পশ্চিম আসমানে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। মনু বলল, ‘বাড়ি যাইতে অইবে, অনেক দিন যাবৎ সন্ধ্যা রাতে বাড়ি ফিরতে পারে নাই। ময়নার লগে ভাত গিলতে পারে নাই। আজ ছোট বোন ময়নার সাথে ভাত খাবে আশা মনুর। ওসমান আপত্তি করল, আজকের রাতটা ওদের ছনের বাসায় কেটে দিতে। গনি সায় দিয়ে বলল, ‘তুলাড্যান্ডি মাছ ভাজা আছে’।
তাছাড়া জ্যোৎসনা রাত্রি আসমানে কোথাও মেঘের অবকাশ নেই। বৃষ্টি হবার সম্ভাবনা কম। খোলা আকাশের নিচে শুকনা বালুর উপর পাতলা পাতলা ছন ছিটিয়ে চাদর বিছিয়ে ঘুমাবে। মনু অল্পতেই রাজি হবার আশংকা সৃষ্টি হওয়ার উপক্রম দেখে রাছেল বজ্জাতটা তুলার ড্যান্ডি মাছের ভাগ না দেওয়ার জন্য বলল মনুর ছোট বোন ময়না একা ঘুমাতে পারবে না। ওসমান মনুর চাচা চাঁনমিয়ার ঘরে ঝামেলা বিবির নিকট থাকবে বলে দিলো। মনু রাছেলের অনিচ্ছা মালুম করে চলে আসল বাড়ি।
সপ্তাহ খানেক বিশ্রাম নিয়ে। হাসেম জোমাদ্দারের বাড়ি বর্ষাকালীন কাজে ভর্তি হয়ে গেলো। চারদিন কাজ করার পরে হাসেম জোমাদ্দার মাতন্ড ঠিক মস্তের উপরে মনুরে বলল, তার মেয়ে রেনুরে নিয়ে বেড়িবাঁধের পার্শ্বে ওয়াবদার কুয়ায় ঝাঁকি জাল লয়ে মাছ ধরতে যেতে। মনু মহাজনের আদেশ মান্য করে রেনুরে কিছু না বলে আবাসনের বেড়ার সাথে ঝুলানো ঝাঁকি জাল ছরা নিয়ে চলে গেল কূয়ায়। রেনু পিছনে ঘটি নিয়ে চলে গেলো। মনু প্রথম কূয়ায় গিয়ে মঞ্জুল গাছের ছোপের আড়ালে খেও দিলো। জাল কিনারে টেনে তুলে দেখল জাল সাদা হয়ে মলান্দা পুঁটি মাছ উঠছে। মনু ঝালের মুঠি থেকে ঝাড়া দিয়ে পুঁটি মাছ ছাড়িয়ে দিলো। রেনু মাছগুলো তুলে ঘটিতে রাখল। ঘটির মাঝামাঝি হয়ে গেল। মনু কনুর সাথে ক্ষেপ বানিয়ে পানিতে ছাড়িল বটে-কিন্তু প্রথম বার শুকনা থাকার জন্য জাল শাপলা ফুলের মতো মেলেছিল। এবার জাল রজনীগন্ধা ফুলের কলির মতো বুজে পরল। একটি মাছও উঠেনি। রেনু বলে, ‘ভাত গিলো নাই কয় দিন অইছে, যে জালে খেও দিতে পার না ’?
মনু বলে, ‘তুই একটা খেও দে দেহি পারলে’।
রেনু বলে, ‘মুই কি পোলা যে খেও দিমু’?
মনু বলে, ‘না পারলে বক বক করিস না চুপ থাক’। তারপর কিছু সময় মাছ ধরে ঘটিটা ভর্তি করে বাড়ি ফিরে আসল।
হাসেম জোমাদ্দারের কবিলা চাতুরী বেগম মলান্দা পূঁটি মাছ কলাপাতায় ভাজি করেছে আর অন্য জাতের মাছ গুলো গোল আলু দিয়ে ঝোল করেছে। কিন্তু কলাপাতার ভাজি মাছটা দারুদ মজা হয়েছে। পরের দিন একই সময় মনু গরুর হাল ছেড়ে নাঙ্গল জোয়াল কাঁধে নিয়ে গোয়াল ঘরের পার্শ্বে রেখে ঘরে আসলে রেনু মাছ ধরতে যাওয়ার আপত্তি করল। মনু শত কষ্ট অনুভব করেও আপত্তি করল না। দু’মুঠো শুকনা মুড়ি চিবিয়ে রহনা হবে এমন ভাব। রেনু মোচরানো বাঁধা জালটা বেড়া হতে নামিয়ে মনুর হাতে দিলো। মনু শত কষ্ট ব্যাথা-বেদনা ভরা ক্লান্ত শরীর লয়ে মাছ ধরার জন্য বেড়িবাঁধের কূয়ায় চলে গেল। রেনু সাথে ছিলো। আগের দিনের লোভে মঞ্জুল গাছের আড়ালে খেও দিয়েছিল বটে- কিন্তু না মাছ নাই। জাল ধূয়ে মুছে উঠেছে। একূয়ায় ওকূয়ায় ঘুরে ঘুরে দশটার মতো খেও দিলো, একটা মাছও উঠল না। মনু বেড়িবাঁধের বাহিরে জোয়ার-ভাটার কূয়ায় খেও দিলো কয়েকটা চামুয়া চিংড়ি মাছ উঠল।
রেনু বলে, ‘মনুন্যা টান দেলে বেশী উঠবে আনে’।
মনু বলে, ‘একলা একলা টান দিমু ক্যামনে ’?
রেনু বলে, ‘ক্যান মুই পাড়ে পাড়ে থাকমু আনে’।
মনু বলে, ‘হেইলে তো দেওয়া যায়’।
রেনুরে পাড়ে দিয়ে মনু একগলা ঘোলানো কাঁদা পানিতে নেমে জাল ধরে টানতে আরাম্ভ করল। হাত দশের মতো সামনে অগ্রসর হওয়া মাত্রই রেনু পানি নিচে লুকানো প্রকান্ড একটা ঝাওয়ার সাথে পায়ের গোড়ালিতে আঘাত পেয়ে বেশী পানিতে হাবু-ডুবু খেয়ে কাঁদা মাখা ঘোলানো পানি গিলতেছে। মনু দেখল রেনুর মাথার কোমড় সমান লম্বা লালচে কেশ শ্যাওলার মতো ভাসছে। আর রেনু পানির নিচে হুড়া-হুড়ি করছে। মনু আলাপ পেয়েছে হাতের জালের টানে। রেনু তো সাঁতার জানত না। মনু জাল ছেড়ে দিয়ে রেনুরে ধরে টেনে দুধের সরের মতো পলি কাঁদায় উঠাল ...... একি ? রেনুর পায়ের গোড়ালি ফেটে তাজা রক্তে পলিমাটি রক্তমাটি হয়ে গেল। রেনুর হুশ নাই। অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছে। মনু তড়িৎ গতিতে পাশের জঙ্গলে খোঁজাখুঁজি করে রক্ত নিবারণী বৈনিয়াপাতা ছিড়ে এনে হাতের তালুতে রেখে অন্য হাতের আঙ্গুল দিয়ে ঘসে মিহিন করে কাটাস্থানে লাগিয়ে দিয়েছে বটে- রক্ত পরা বন্ধ হলো না। হবে কেন ? কমতো আর ফাটে নাই। রক্ত দেখে মনুর চ্যাংরা-চ্যাংরা ভাব। তারপরও নিজেকে অস্বভাবিক না করে সমস্ত মেরুদন্ডে কাঁদা মাখা, পায়ের রক্ত জড়া রেনুকে কাঁধে নিয়ে বাড়িতে আসল। উঠানে গিয়ে চাতুরী বেগম কে ডেকে বলল, ‘চাচিমা সব্বনাস রেনু পা হইতে রক্ত পরছে’।
চাতুরী বেগম জট পট ঘরের বাহিরে এসে মেয়ের অবস্থা দেখে মনুরে ধমক দিয়ে বলল,
‘হারামজাদা মনুন্যা খয়রাতির বাচ্চা তুই মোর মাইয়্যাডার সব্বনাস করছ’।
কি সর্বনাশ করছে মনু ?
মনু চাতুরী বেগমের জবাব না দিয়ে বলে, ‘আমনে একটা ওগলা আনেন’।
চাতুরী বেগম ঘরে ডুকে একটা হেউলি পাতার ওগলা এসে উঠানে বিছে দিলো। মনু কাঁধ থেকে কাঁদা মাখা রেনুরে শুয়ে দিলো। তারপর যা করার চাতুরী বেগম করল। মনু হাফাতে হাফাতে কূয়ার নিকট থেকে জাল,ঘটি আনার জন্য চলে গেল। বাড়ি ফিরে জালটা উঠানে রাখার মনস্তাব করার আগে চাতুরী বেগম দু’খুড়া বিশিষ্ট একটা পিঁড়ি নিয়ে মনুর পিছনের মেরুদন্ডের বাহুতে কষে একটা পিটান দিলো। মনু জালটা ফেলে দিয়ে ওরে.....মা, ওরে....বাবা বলে দৌড় দিয়ে বাড়ির দরজায় হাত তিনেক চওড়া পথের দুপাশে সারি বদ্ধভাবে লাগানো মেহগনি গাছের রাস্তায় যেতেই হাসেম জোমাদ্দারের শরীরের সাথে ধাক্কা খেয়ে মাটিতে পরে গেলো। হাসেম জোমাদ্দার হাল-চাষ করার গরু ঘাসে বেঁধে বাড়ি ফিরছিল। মনুরে কনু ধরে উঠিয়ে জিজ্ঞাসা করল কি ঘটনা ঘটেছে ? কিন্তু মনু কাঁন্নার ঢেউ থামাতে পারল না, জবাব দিবে কিভাবে ? মনুরে সাথে নিয়ে উঠানে রেনুর পাশে পাতানো হেউলি পাতার ওগলায় বসে হাসেম জোমাদ্দার চাতুরী বেগমের কাছে জানতে চায় কি ঘটেছে ? চাতুরী বেগম একটা ককর্শ ভাষায় গালি দিয়ে বলল,
‘হারামির বাচ্চায় মোর মাইয়্যাডারে সব্বনাস করছে ’।
হাসেম জোমাদ্দার মনুর কাছে জানতে চাইল কি হয়েছে ? বুকের কাঁন্নার ঢেউ থামিয়ে মনু মুখ খুলে বলতে আরাম্ভ করল। হঠাৎ রেনু চোখের পাপড়ী খুলে শোয়া থেকে বসবে এমন মুহূর্তে হেউলি পাতার ওগলার সাথে ঘসা লেগে পুনরায় রক্ত বের হতে আরাম্ভ করল। চাতুরী বেগম ঘর হতে একটা আস্তা পান বোটাশুদ্ধ মুখে দিয়ে চিবিয়ে রেনুর পায়ের কাটাস্থানে লাগিয়ে দিলো। হাসেম জোমাদ্দার বাড়ির দরজা হতে এক মুঠো দুলবা ঘাস চিবিয়ে মিহি করে কাটাস্থানে লাগিয়ে বেঁধে দিলো। মনু কোন কথা বলার সুযাগ পেল না। চাতুরী বেগম চক্ষু বড় বড় করে বার বার মনুর দিকে কড়া মেজাজে তাকায়।
রেনু মনুর চোখ বেয়ে লোনা জল পরতে দেখে বলে , ‘মা মনুন্যার চোহে পানি ক্যন’?
চাতুরী বেগম বলে, ‘বদমাশটা তোর এ অবস্থা করছে’।
রেনু একটু দরদ সঞ্চয় করে বলে, ‘মনুন্যা মোরে কি করছে’?
তারপর হাসেম জোমাদ্দারের অনুরোধে রেনু সব ঘটে যাওয়া ঘটনা বলে দিলো। চাতুরী বেগম নিজেকে একটু অপরাধী মনে করে জিহ্বায় কামড় খেয়ে ঘরে ডুকে পরিল। হাসেম জোমাদ্দার মনুরে কাছে টেনে মাখায় হাত বুলিয়ে দরদ দেখিয়ে চাতুরী বেগমের কাজের জন্য শান্তনা দিলো।
ধীরে ধীরে হালুটি শেষ হলে গেলো। কিন্তু মনুর পা হাটার অনুপযুক্ত। পা কাঁদার মধ্যে অদেখা পোকায় ও পানিতে ভিজে, রাতের অন্ধকারে তেলাপোকায় চুরি করে খুটে খুটে খেয়েছে। ফুলে এক পা দুপায়ের সমান হয়েছে। সন্ধ্যা বেলায় মনু বাড়িতে জামা কাপড় ও গামছা নিয়ে চলে আসল। সাঝেঁর বেলা চাঁনমিয়া মনুর পা দেখে ঘরে থাকা তুতে ও ফেটকরি লাগিয়ে দিলো। এমন জোড়ে একটা কামড় দিলো তাতে কত যন্ত্রনা তা মনু ছাড়া কেহ জানে না। মনু হাটার অযোগ্য পা নিয়ে যন্ত্রনার চোটে লাফা লাফি আরাম্ভ করে দিলো। কিছু সময় পর শান্ত হলো। মনু একেবারে মহাজন বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে এসেছে- তা নয়। দিন দুই বিশ্রাম নিয়ে আবার দিন তিনেক রোপন করা খেতের আগাছা পরিস্কার করতে হবে। এখানকার মহাজনদের অভ্যাসে পরিনত হয়েছে। মাসিক বেতনের কাঝের লোকদের দিয়ে আগাছা পরিস্কার করে বিদায় দিতে হবে। কিন্তু মনু বেহাল পা নিয়ে আগাছা পরিস্কার করবে কেমনে ? দু’দিন শুকনায় থাকলে একটু সুবিধা হবে মনুর ধারণা। কিন্তু না মোটেও সুবিধা হলো না। চাঁনমিয়া পরের দিন হাসেম জোমাদ্দারের বাড়িতে গিয়ে দেখতে পেল অন্য কাজের লোক ছলেমান ও সোনামিয়া এসেছে। খেতে আগাছা পরিস্কার করতে রহনা হচ্ছে। ওরা চাঁনমিয়ার কাছে জিজ্ঞাসা করল ‘মনু যাইবে না ’? হাসেম জোমাদ্দার ছোট কামরায় ঝলচকিতে বসে কলকিতে তামাক টানছে। চাঁনমিয়ার কাছে হাসেম জোমাদ্দার কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই চাঁনমিয়া বলল, ‘মুনর পাও ফুলিয়া ওঠছে, আটতে পারে না ভাল হইরর্যা’।
হাসেম জোমাদ্দার দরদ করে বলল, ‘চান বাই যাও ভাল করে তালাপি করুক, কামে আইতে অবেনা’।
আর হোন বাই ‘আগামী সোমবার মনুন্যারে লইয়্যা আইয়্যা বিদার খাওয়া খাইয়্যা যাইও’।
চাঁনমিয়া জোমাদ্দারের প্রতি বির বির করে আর্শিবাদ করতে করতে বাড়ি চলে আসল।
ময়নারে বলল ‘একটু পানি তাপ দিয়ে মনুর পা ধূইতে’।
ময়না তাই করল। এইভাবে পর্যায়ক্রমে গরু-মহিষ রাখা, তরমুজ ক্ষেতের কাজ ও বর্ষাকালে হালুটির কাজ করল বেশ কয়েক বছর মনু।
-----------------*****-------------
চাতুরী বেগম বলে, ‘বদমাশটা তোর এ অবস্থা করছে’।
রেনু একটু দরদ সঞ্চয় করে বলে, ‘মনুন্যা মোরে কি করছে’?
তারপর হাসেম জোমাদ্দারের অনুরোধে রেনু সব ঘটে যাওয়া ঘটনা বলে দিলো। চাতুরী বেগম নিজেকে একটু অপরাধী মনে করে জিহ্বায় কামড় খেয়ে ঘরে ডুকে পরিল। হাসেম জোমাদ্দার মনুরে কাছে টেনে মাখায় হাত বুলিয়ে দরদ দেখিয়ে চাতুরী বেগমের কাজের জন্য শান্তনা দিলো।
ধীরে ধীরে হালুটি শেষ হলে গেলো। কিন্তু মনুর পা হাটার অনুপযুক্ত। পা কাঁদার মধ্যে অদেখা পোকায় ও পানিতে ভিজে, রাতের অন্ধকারে তেলাপোকায় চুরি করে খুটে খুটে খেয়েছে। ফুলে এক পা দুপায়ের সমান হয়েছে। সন্ধ্যা বেলায় মনু বাড়িতে জামা কাপড় ও গামছা নিয়ে চলে আসল। সাঝেঁর বেলা চাঁনমিয়া মনুর পা দেখে ঘরে থাকা তুতে ও ফেটকরি লাগিয়ে দিলো। এমন জোড়ে একটা কামড় দিলো তাতে কত যন্ত্রনা তা মনু ছাড়া কেহ জানে না। মনু হাটার অযোগ্য পা নিয়ে যন্ত্রনার চোটে লাফা লাফি আরাম্ভ করে দিলো। কিছু সময় পর শান্ত হলো। মনু একেবারে মহাজন বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে এসেছে- তা নয়। দিন দুই বিশ্রাম নিয়ে আবার দিন তিনেক রোপন করা খেতের আগাছা পরিস্কার করতে হবে। এখানকার মহাজনদের অভ্যাসে পরিনত হয়েছে। মাসিক বেতনের কাঝের লোকদের দিয়ে আগাছা পরিস্কার করে বিদায় দিতে হবে। কিন্তু মনু বেহাল পা নিয়ে আগাছা পরিস্কার করবে কেমনে ? দু’দিন শুকনায় থাকলে একটু সুবিধা হবে মনুর ধারণা। কিন্তু না মোটেও সুবিধা হলো না। চাঁনমিয়া পরের দিন হাসেম জোমাদ্দারের বাড়িতে গিয়ে দেখতে পেল অন্য কাজের লোক ছলেমান ও সোনামিয়া এসেছে। খেতে আগাছা পরিস্কার করতে রহনা হচ্ছে। ওরা চাঁনমিয়ার কাছে জিজ্ঞাসা করল ‘মনু যাইবে না ’? হাসেম জোমাদ্দার ছোট কামরায় ঝলচকিতে বসে কলকিতে তামাক টানছে। চাঁনমিয়ার কাছে হাসেম জোমাদ্দার কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই চাঁনমিয়া বলল, ‘মুনর পাও ফুলিয়া ওঠছে, আটতে পারে না ভাল হইরর্যা’।
হাসেম জোমাদ্দার দরদ করে বলল, ‘চান বাই যাও ভাল করে তালাপি করুক, কামে আইতে অবেনা’।
আর হোন বাই ‘আগামী সোমবার মনুন্যারে লইয়্যা আইয়্যা বিদার খাওয়া খাইয়্যা যাইও’।
চাঁনমিয়া জোমাদ্দারের প্রতি বির বির করে আর্শিবাদ করতে করতে বাড়ি চলে আসল।
ময়নারে বলল ‘একটু পানি তাপ দিয়ে মনুর পা ধূইতে’।
ময়না তাই করল। এইভাবে পর্যায়ক্রমে গরু-মহিষ রাখা, তরমুজ ক্ষেতের কাজ ও বর্ষাকালে হালুটির কাজ করল বেশ কয়েক বছর মনু।
-----------------*****-------------
No comments