গঙ্গামতির রাখাল-(পর্ব-চার)
গঙ্গামতির রাখাল-(পর্ব-চার)
Novel Cover Photo
কয়েক বছর পরের কথা।
মনুর বয়স তের বৎসর হয়ে পার হলো। মনুর চাচা চাঁনমিয়া ধ্যান করল ভাইপোকে সাধি করানো দরকার। মনুর বয়সের দু’বছরের ছোট ইমাদুল সাধি করেছে তাও আবার গত বছর। রাখার পাড়ার পাশের গ্রামের আলো কাজীর সন্তান ইমাদুল। চরচাপলী গ্রামের মঞ্জু মিয়ার সর্ব কনিষ্ট দশ বছরের কন্যা ছায়া কে সাধি করেছে আড়াই হাজার টাকা যৌতুক নিয়ে। আহারে.... দশ বছরের ছায়া অন্তস্বত্ত্বা। ঝামেলা বিবি একদিন দু’খন্ডা শুকনো মরিচ কর্জ আনতে গিয়েছিল সেকালে ঝামেলা বিবির চোখে পড়েছে। ঝামেলা বিবি ও চাঁনমিয়া যৌথভাবে পরামর্শ করে সর্বশেষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে-মনুর জন্য একটা রমনী আনবে।
হঠাৎ কোন একদিন মনুরে ডেকে বলল, সাধির কথা। মনু নাখোশ করে যা বলেছিল-তা যুক্তি সংঘত না। কারণ মনুর ঘরে আদরের ছোট বোন ময়না। সাধি করে অন্য গোত্রের বনিতা ঘরে আনলে, ময়নার সাথে মিলতে যদি না পারে ? তাহলে ঝামেলা সৃষ্টি হবে। তার চেয়ে আগে ময়নারে সাধি দিয়ে, পরে নিজে বিয়ে করবে।
‘মনু পাঠশালা, বিদ্যাপিঠে যেতে পারেনি, তারপরও মুর্খ গবাদি পশুর রাখাল, মোটামুটি ধারণা কম ছিল না’।
মনু ভাবছে ময়নারে কিভাবে বিবাহ দিবে ? কম হলেও তো হাজার পাঁচেক টাকার দরকার। সামনের মাসের সমস্ত মাহিনার টাকা একত্রিত করে বিয়ে দিবে ময়নারে। মাহিনার টাকায় না হলে খালেক প্যাদার কাছে বোনের বিয়ের জন্য কিছু টাকা অগ্রীম দাবি করবে। খালেক প্যাদা দয়ালু মানুষ না বলতে পারবে না।
ওদিকে ওসমান ময়নারে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে আরাম্ব করছে। ময়না দেখতে হালকা কালো, নয়ন দুটো ভরা পাপড়ীগুলো সাজানো, দেখলে মনে হয়, ময়না সমস্ত দিন যেন পাপড়ীগুলো চিরুনী দ্বারা বাইল করে রাখে। মস্তকের কেশ হালকা হালকা বাঁকানো দেখতে ভাল লাগে ওসমানের। কচি ময়নার ছোট গোল গালে মাঝারি একটি তিলা। ওসমানের ধারণা উপরওয়ালা যদি ময়নার অন্য গালেও একটা কালো তিলা দিত তাহলে আরো বেশী ভাল লাগত। ময়নার চেহারায় কোন মালিন্য নাই- শুধু একটি মরিচা আছে, তা হলো বাম হাতে একটি আঙ্গুল অগ্রিম। ওসমান চক্ষু মেলে দেখেছে ময়না যদি দক্ষিণ বাংলার লোনা অঞ্চলের বদলে অন্য কোন স্থানে থাকত তাহলে কালো থাকত না ফর্সা হয়ে যেত। ওসমান গরু-মহিষ রাখার ফাঁকে ফাঁকে ময়নারে নিয়ে ইন্দ্রেরাজ্যে এক বুক বাসনা জন্ম দিয়ে প্রহর গুনত। মাঝে মধ্যে দুপুরের আহার্য শেষ করে ময়নারে দেখার উদ্দেশ্যে মনুর কুড়ের নিবাসে ডুকে বলত, ‘মনু এ্যাহনও খাওয়া অয় নাই’?
যেদিন নীড়ে ডুকে ময়নারে চোখে না পরে ওসমান বলত, ‘মনু তোর আদরের বোইডা বুঝি বেড়াইতে গ্যাছে’।
মনু বলত ‘বেড়াইতে যাইবে কৈ, জাগা আছে নাহি ’? শুধু নানা বাড়ি আছে সেতো বহু দূরে, যেতে একশত টাকা ভাড়া লাগে। মায় মারা যাওয়ার পর নানারা খোঁজ খবর রাখে না। এই ফাঁকে ময়না ঘরে আসলেই ওসমান বারোং বার গালে গোল মাঝারি কালো তিলাটা দেখে লইত। মনু দেখলে কি বলবে ? ডরটা আছে ওসমানের। চালাকি করে বলত, ‘ল ... মনুন্যা ল..... চরে ল....’। মনু উঠে হাটতে আরাম্ভ করল। ওসমান মনুর পাছায় পরে পিছনে ফিরে তাকিয়ে একনজর ময়নার পায়ের পাতা হতে মাথার বাঁকানো কেশ পর্যন্ত দেখে নিত। ময়না শরম পেয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রাখত।
ওসমান মনু গঙ্গামতির চরে চলে গেল। রাছেল ও গনি এখনও যায় নাই। দু’জনে একটি প্রকান্ড বাইন গাছের ছায়ায় বসে রাছেল,গনির জন্য অপেক্ষা করছে। মুহূর্তের মধ্যে ওরা দু’জন গঙ্গামতির চরে আসল। চারজন একাত্রিত হয়ে উঁচু বালুর ধূমে বড় মৌফল গাছের ছায়ায় বসে ‘পাতাছিট’ খেলতে আরাম্ভ করল। ঘন্টা খানিক পরে গরু-মহিষ এলোমেলো হয়ে তফাতে বাস্তহারা গ্রামের দিকে অগ্রসর হয়ে গেছে। মনু বলল, ‘গরু-মহিষ ফারাকে গ্যাছে’। সকলে ‘পাতাছিট’ খেলা বিরত রেখে হাতের ‘পাচইন’ নিয়ে ছন ক্ষেতের মধ্যে ছিলায় ছিলায় রহনা দিলো। গরু-মহিষের পালের নিকট গিয়ে ওসমান ও গনি জঙ্গনের কিনারা হতে বনের মধ্যে প্রবেশ করল গরু-মহিষ একাত্র করতে। ওসমান বলে, ‘তুই মোর একটা হুগার করতে পার ’?
গনি বলে, ‘কি হুগার’?
ওসমান বলে, ‘মুই মনুন্যার বোইন ময়নারে ভাল লাগাইয়া হলাইছি, তুই মনুন্যার লগে একটু আলাপ করইর্যা দ্যাখতে পার কি কয় ’।
গনি বলে, ‘পারমু না কেন আইজই আলাপ করমু আনে’।
গরিু- মহিষ একাত্র করে ফিরতি খেলতে আরাম্ব করল- তবে পাতাছিট না ডেং। রাছেল আর ওসমান ডেং খেলতে আরাম্ভ করল। গনি মনুকে ডাক দিয়ে একটু তফাতে গিয়ে বসে বলে, ‘মনু তোরে একটা কতা কইতে বোলাইছি’।
মনু বলে, ‘কি কতা কবি ক ’।
গনি বলে, ‘তোর আদরের বোইন ময়নারে ওসমাইন্যা ভাল লাগাইয়্যা হালাছে, তুই কি কও’।
মনু বলে, ‘হে মুই কইতে পারমু না, চাচায় জানে ? তাছাড়া ওসমানের বাহে-মায় নিবে নাকি ?
গনি বলে, ‘তোর আপত্তি না থাকলে মুই ওর বাহে-মার লগে কতা কমু আনে’। আর তুই তোর চাচার লগে জিগাইয়া দেহিস’।
তারপর ডেং খেলতে রহনা হলো। ওসমানের বুঝতে বাকি থাকলো না মনু গনি কি আলাপ করেছে। রাছেল কিছুই বুঝল না। জিজ্ঞাসা করল ‘তোরা দুজনে মতলবটা হরলি কি ’?
গনি বলে, ‘হ্যা দিয়া তোর কাম কি’?
ওসমান চোখ তুলে তাকাতে পারল না মনুর দিকে। মনুর একটু শরম শরম লাগছে। সন্ধ্যায় গরু-মহিষ যথাস্থানে রেখে একাত্রিত হয়ে গঙ্গামতির রাখায় পাড়ায় চলে আসল। মনু নিজের ঘরে যাবার আগে চাচা চাঁনমিয়ার কুটিরে গিয়ে বলে,‘চাচা মোগো ময়নারে ওসমাইন্যা বিয়া হরতে চায়’।
চাঁনমিয়া বলে, ‘ওসমানের বাহে কি কয় ’?
মনু বলে, ‘হ্যা মুই কমু ক্যামনে, আমনে আলাপ হইর্যা দ্যাহেন’।
রাত গত হয়ে গেল, সাঁঝের বেলায় চাঁনমিয়া ওসমানের বাপ হায়দার আলীর কুটিরে গিয়ে হায়দার আলীকে ডাক দিলো। হায়দার আলী বলে, ‘চান বাই বহো বারান্দায় আইতে আছি’।
হায়দার আলী আবাসনের পিছনে বাতাসে হেলে পড়া পেঁপেঁ গাছটায় ডেহর দিতেছে। হায়দার আলীর ডেহর দিতে হবে তাই চাঁনমিয়াকে ডাক দিয়ে ঘরের পিছনে যেতে অনুরোধ করল। চাঁনমিয়া চলে গেল হায়দার আলী নিকটে। হায়দার আলী বলে, ‘কিছু কইবা চান বাই’?
চাঁনমিয়া বলল, ‘হ্যাঁ কিছু তইবার আইছি’।
হায়দার আলী বলল, ‘হ্যাঁ কও না কি কইবা’।
চঁনমিয়া বলে দিলো ওসমানের ময়নারে ভাল লাগার কথা। হায়দার আলী ময়নারে ওসমানের জন্য বউ বানাতে আপত্তি নাই। আগামী রোববার বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে নিলো। আজ সোমবার চাঁনমিয়া জিজ্ঞাসা করল হায়দার আলী চাহিদা কি ? হায়দার আলী নিজের পোলার জন্য কিছুই চায় নাই। শুধু আগাম পুত্র বধূর জন্য কানের দুল একজোড়া। কানের দুল নিয়ে ভাবতে হবে না। কারণ মনুর মা শরভানু মারা যাবার কালে পুরানো একজোড়া গহনা রেখেছে। ঐ জোড়া স্বর্ণকার হতে ধোলাই করলে নতুন হবে। চাঁনমিয়া বলল,
‘ অহন যাই মিয়া কতার যানো হেরফের হয় না।
চাঁনমিয়া ঘরে চলে গেলো। চাঁনমিয়া ও হায়দার আলী ঘরের মাঝে গনি ও রাছেলের বাপের ঘর। মনু তাড়াহুড়া করে চাঁনমিয়ার মুখোমুখি হয়ে জিজ্ঞাসা করল, হায়দার আলী মতলব কি ? চাঁনমিয়ার মুখে শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘চাচা ওসমাইনন্যা খারাপ না মোরে হারাদিন কামে সাহায্য হরে’।
মনু, চাঁনমিয়া ও ঝামেলা বিবি একাত্রিত হয়ে বুদ্ধি করল সম্বন্ধের যায় যোগার প্রসঙ্গে। তিনজনের যৌথ আলোচনায় সিদ্ধান্ত হলো, হাজার পাঁচেক টাকা লাগবে। কিন্তু মনুর কাছে একটা টাকাও নাই। চাঁনমিয়া মনুরে হাজার খানেক টাকা জোগার করতে বলেছে, বাকী যা লাগে চাঁনমিয়া মেনেজ করবে। মনু চিন্তায় পরে গেলো। কোথায় এত টাকা পাবে ? চাঁনমিয়া বলে দিলো এখনও সাত দিন সময় আছে। খালেক প্যাদা, আমজেদ ব্যাপারী ও রশিদ কাজী নিকট যেতে। চলতি মাসের মাহিনা ও অগ্রীম কিছু টাকা বোনের সাধির জন্য দাবি করবে মনস্তাব করল মনু। না বলতে পারবে না, কারণ মনুরে তারা ভাল জানে।
মনুর বয়স তের বৎসর হয়ে পার হলো। মনুর চাচা চাঁনমিয়া ধ্যান করল ভাইপোকে সাধি করানো দরকার। মনুর বয়সের দু’বছরের ছোট ইমাদুল সাধি করেছে তাও আবার গত বছর। রাখার পাড়ার পাশের গ্রামের আলো কাজীর সন্তান ইমাদুল। চরচাপলী গ্রামের মঞ্জু মিয়ার সর্ব কনিষ্ট দশ বছরের কন্যা ছায়া কে সাধি করেছে আড়াই হাজার টাকা যৌতুক নিয়ে। আহারে.... দশ বছরের ছায়া অন্তস্বত্ত্বা। ঝামেলা বিবি একদিন দু’খন্ডা শুকনো মরিচ কর্জ আনতে গিয়েছিল সেকালে ঝামেলা বিবির চোখে পড়েছে। ঝামেলা বিবি ও চাঁনমিয়া যৌথভাবে পরামর্শ করে সর্বশেষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে-মনুর জন্য একটা রমনী আনবে।
হঠাৎ কোন একদিন মনুরে ডেকে বলল, সাধির কথা। মনু নাখোশ করে যা বলেছিল-তা যুক্তি সংঘত না। কারণ মনুর ঘরে আদরের ছোট বোন ময়না। সাধি করে অন্য গোত্রের বনিতা ঘরে আনলে, ময়নার সাথে মিলতে যদি না পারে ? তাহলে ঝামেলা সৃষ্টি হবে। তার চেয়ে আগে ময়নারে সাধি দিয়ে, পরে নিজে বিয়ে করবে।
‘মনু পাঠশালা, বিদ্যাপিঠে যেতে পারেনি, তারপরও মুর্খ গবাদি পশুর রাখাল, মোটামুটি ধারণা কম ছিল না’।
মনু ভাবছে ময়নারে কিভাবে বিবাহ দিবে ? কম হলেও তো হাজার পাঁচেক টাকার দরকার। সামনের মাসের সমস্ত মাহিনার টাকা একত্রিত করে বিয়ে দিবে ময়নারে। মাহিনার টাকায় না হলে খালেক প্যাদার কাছে বোনের বিয়ের জন্য কিছু টাকা অগ্রীম দাবি করবে। খালেক প্যাদা দয়ালু মানুষ না বলতে পারবে না।
ওদিকে ওসমান ময়নারে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে আরাম্ব করছে। ময়না দেখতে হালকা কালো, নয়ন দুটো ভরা পাপড়ীগুলো সাজানো, দেখলে মনে হয়, ময়না সমস্ত দিন যেন পাপড়ীগুলো চিরুনী দ্বারা বাইল করে রাখে। মস্তকের কেশ হালকা হালকা বাঁকানো দেখতে ভাল লাগে ওসমানের। কচি ময়নার ছোট গোল গালে মাঝারি একটি তিলা। ওসমানের ধারণা উপরওয়ালা যদি ময়নার অন্য গালেও একটা কালো তিলা দিত তাহলে আরো বেশী ভাল লাগত। ময়নার চেহারায় কোন মালিন্য নাই- শুধু একটি মরিচা আছে, তা হলো বাম হাতে একটি আঙ্গুল অগ্রিম। ওসমান চক্ষু মেলে দেখেছে ময়না যদি দক্ষিণ বাংলার লোনা অঞ্চলের বদলে অন্য কোন স্থানে থাকত তাহলে কালো থাকত না ফর্সা হয়ে যেত। ওসমান গরু-মহিষ রাখার ফাঁকে ফাঁকে ময়নারে নিয়ে ইন্দ্রেরাজ্যে এক বুক বাসনা জন্ম দিয়ে প্রহর গুনত। মাঝে মধ্যে দুপুরের আহার্য শেষ করে ময়নারে দেখার উদ্দেশ্যে মনুর কুড়ের নিবাসে ডুকে বলত, ‘মনু এ্যাহনও খাওয়া অয় নাই’?
যেদিন নীড়ে ডুকে ময়নারে চোখে না পরে ওসমান বলত, ‘মনু তোর আদরের বোইডা বুঝি বেড়াইতে গ্যাছে’।
মনু বলত ‘বেড়াইতে যাইবে কৈ, জাগা আছে নাহি ’? শুধু নানা বাড়ি আছে সেতো বহু দূরে, যেতে একশত টাকা ভাড়া লাগে। মায় মারা যাওয়ার পর নানারা খোঁজ খবর রাখে না। এই ফাঁকে ময়না ঘরে আসলেই ওসমান বারোং বার গালে গোল মাঝারি কালো তিলাটা দেখে লইত। মনু দেখলে কি বলবে ? ডরটা আছে ওসমানের। চালাকি করে বলত, ‘ল ... মনুন্যা ল..... চরে ল....’। মনু উঠে হাটতে আরাম্ভ করল। ওসমান মনুর পাছায় পরে পিছনে ফিরে তাকিয়ে একনজর ময়নার পায়ের পাতা হতে মাথার বাঁকানো কেশ পর্যন্ত দেখে নিত। ময়না শরম পেয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রাখত।
ওসমান মনু গঙ্গামতির চরে চলে গেল। রাছেল ও গনি এখনও যায় নাই। দু’জনে একটি প্রকান্ড বাইন গাছের ছায়ায় বসে রাছেল,গনির জন্য অপেক্ষা করছে। মুহূর্তের মধ্যে ওরা দু’জন গঙ্গামতির চরে আসল। চারজন একাত্রিত হয়ে উঁচু বালুর ধূমে বড় মৌফল গাছের ছায়ায় বসে ‘পাতাছিট’ খেলতে আরাম্ভ করল। ঘন্টা খানিক পরে গরু-মহিষ এলোমেলো হয়ে তফাতে বাস্তহারা গ্রামের দিকে অগ্রসর হয়ে গেছে। মনু বলল, ‘গরু-মহিষ ফারাকে গ্যাছে’। সকলে ‘পাতাছিট’ খেলা বিরত রেখে হাতের ‘পাচইন’ নিয়ে ছন ক্ষেতের মধ্যে ছিলায় ছিলায় রহনা দিলো। গরু-মহিষের পালের নিকট গিয়ে ওসমান ও গনি জঙ্গনের কিনারা হতে বনের মধ্যে প্রবেশ করল গরু-মহিষ একাত্র করতে। ওসমান বলে, ‘তুই মোর একটা হুগার করতে পার ’?
গনি বলে, ‘কি হুগার’?
ওসমান বলে, ‘মুই মনুন্যার বোইন ময়নারে ভাল লাগাইয়া হলাইছি, তুই মনুন্যার লগে একটু আলাপ করইর্যা দ্যাখতে পার কি কয় ’।
গনি বলে, ‘পারমু না কেন আইজই আলাপ করমু আনে’।
গরিু- মহিষ একাত্র করে ফিরতি খেলতে আরাম্ব করল- তবে পাতাছিট না ডেং। রাছেল আর ওসমান ডেং খেলতে আরাম্ভ করল। গনি মনুকে ডাক দিয়ে একটু তফাতে গিয়ে বসে বলে, ‘মনু তোরে একটা কতা কইতে বোলাইছি’।
মনু বলে, ‘কি কতা কবি ক ’।
গনি বলে, ‘তোর আদরের বোইন ময়নারে ওসমাইন্যা ভাল লাগাইয়্যা হালাছে, তুই কি কও’।
মনু বলে, ‘হে মুই কইতে পারমু না, চাচায় জানে ? তাছাড়া ওসমানের বাহে-মায় নিবে নাকি ?
গনি বলে, ‘তোর আপত্তি না থাকলে মুই ওর বাহে-মার লগে কতা কমু আনে’। আর তুই তোর চাচার লগে জিগাইয়া দেহিস’।
তারপর ডেং খেলতে রহনা হলো। ওসমানের বুঝতে বাকি থাকলো না মনু গনি কি আলাপ করেছে। রাছেল কিছুই বুঝল না। জিজ্ঞাসা করল ‘তোরা দুজনে মতলবটা হরলি কি ’?
গনি বলে, ‘হ্যা দিয়া তোর কাম কি’?
ওসমান চোখ তুলে তাকাতে পারল না মনুর দিকে। মনুর একটু শরম শরম লাগছে। সন্ধ্যায় গরু-মহিষ যথাস্থানে রেখে একাত্রিত হয়ে গঙ্গামতির রাখায় পাড়ায় চলে আসল। মনু নিজের ঘরে যাবার আগে চাচা চাঁনমিয়ার কুটিরে গিয়ে বলে,‘চাচা মোগো ময়নারে ওসমাইন্যা বিয়া হরতে চায়’।
চাঁনমিয়া বলে, ‘ওসমানের বাহে কি কয় ’?
মনু বলে, ‘হ্যা মুই কমু ক্যামনে, আমনে আলাপ হইর্যা দ্যাহেন’।
রাত গত হয়ে গেল, সাঁঝের বেলায় চাঁনমিয়া ওসমানের বাপ হায়দার আলীর কুটিরে গিয়ে হায়দার আলীকে ডাক দিলো। হায়দার আলী বলে, ‘চান বাই বহো বারান্দায় আইতে আছি’।
হায়দার আলী আবাসনের পিছনে বাতাসে হেলে পড়া পেঁপেঁ গাছটায় ডেহর দিতেছে। হায়দার আলীর ডেহর দিতে হবে তাই চাঁনমিয়াকে ডাক দিয়ে ঘরের পিছনে যেতে অনুরোধ করল। চাঁনমিয়া চলে গেল হায়দার আলী নিকটে। হায়দার আলী বলে, ‘কিছু কইবা চান বাই’?
চাঁনমিয়া বলল, ‘হ্যাঁ কিছু তইবার আইছি’।
হায়দার আলী বলল, ‘হ্যাঁ কও না কি কইবা’।
চঁনমিয়া বলে দিলো ওসমানের ময়নারে ভাল লাগার কথা। হায়দার আলী ময়নারে ওসমানের জন্য বউ বানাতে আপত্তি নাই। আগামী রোববার বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে নিলো। আজ সোমবার চাঁনমিয়া জিজ্ঞাসা করল হায়দার আলী চাহিদা কি ? হায়দার আলী নিজের পোলার জন্য কিছুই চায় নাই। শুধু আগাম পুত্র বধূর জন্য কানের দুল একজোড়া। কানের দুল নিয়ে ভাবতে হবে না। কারণ মনুর মা শরভানু মারা যাবার কালে পুরানো একজোড়া গহনা রেখেছে। ঐ জোড়া স্বর্ণকার হতে ধোলাই করলে নতুন হবে। চাঁনমিয়া বলল,
‘ অহন যাই মিয়া কতার যানো হেরফের হয় না।
চাঁনমিয়া ঘরে চলে গেলো। চাঁনমিয়া ও হায়দার আলী ঘরের মাঝে গনি ও রাছেলের বাপের ঘর। মনু তাড়াহুড়া করে চাঁনমিয়ার মুখোমুখি হয়ে জিজ্ঞাসা করল, হায়দার আলী মতলব কি ? চাঁনমিয়ার মুখে শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘চাচা ওসমাইনন্যা খারাপ না মোরে হারাদিন কামে সাহায্য হরে’।
মনু, চাঁনমিয়া ও ঝামেলা বিবি একাত্রিত হয়ে বুদ্ধি করল সম্বন্ধের যায় যোগার প্রসঙ্গে। তিনজনের যৌথ আলোচনায় সিদ্ধান্ত হলো, হাজার পাঁচেক টাকা লাগবে। কিন্তু মনুর কাছে একটা টাকাও নাই। চাঁনমিয়া মনুরে হাজার খানেক টাকা জোগার করতে বলেছে, বাকী যা লাগে চাঁনমিয়া মেনেজ করবে। মনু চিন্তায় পরে গেলো। কোথায় এত টাকা পাবে ? চাঁনমিয়া বলে দিলো এখনও সাত দিন সময় আছে। খালেক প্যাদা, আমজেদ ব্যাপারী ও রশিদ কাজী নিকট যেতে। চলতি মাসের মাহিনা ও অগ্রীম কিছু টাকা বোনের সাধির জন্য দাবি করবে মনস্তাব করল মনু। না বলতে পারবে না, কারণ মনুরে তারা ভাল জানে।
দিন দুই পরে সূর্য মাথার উপর অনুমান নয়নে দেখা যায় না। আসমান কালো মেঘে আচ্ছন্ন, চলে গেল মহাজনালয়। বলে আসল বোনের বিয়ের জন্য টাকার দরকার হবে। খালেক প্যাদা বলে দিলো যত টাকা লাগবে দিবে। আমজেদ ব্যাপারীও ব্যতিক্রম কিছু বলে নাই। রশিদ কাজী বলল, এ মাসে তার টাকা হবে না। কারন তার সামনে মোকর্দ্দমায় হাজিরা দিতে হবে।
বৃহস্পতিবার রাতে মনু চাচা চাঁনমিয়ারে নিয়ে মাহিনা আনতে গেল। চলে গেল খালেক প্যাদা ও আমজেদ ব্যাপারী দু’জনে দুই হাজার টাকা দিয়ে দিলো। টাকা নিয়ে ফুর্তিতে আবাসনে ফিরে আসল। পরের দিন হাট বাজার যা দরকার তা চাপলীর বাজার থেকে কেনা কাটা করল। কিন্তু ওসমানের সাথে ময়নার সাধি হবে না তা কে জানত। সকাল বেলা সকলে এক সাথে গরু-মহিষ রাখতে চলে গেল গঙ্গামতির চরে। গরু-মহিষ জঙ্গলে ছেড়ে ওরা চারজনে ‘শীতাফল’ টোকাতে হাড়কুচি বনে প্রবেশ করল। কিছু সময় ‘শীতাফল’ টোকায় একটু তফাতে তিনজন এমন সময় ওসমানের- ওরে.... খোদা, ওরে....বাবা, ওরে....মা বলে চিৎকার শোনা গেলো। ওরা তিনজন দৌড়ে ওসমানের নিকট অগ্রসর হয়ে দেখল ওসমান লোনা মাটির কেওড়া গাছের শত হুলার মধ্যে কাঁদা মাটির উপরে পরে আছে। মনু কি হয়েছে জিজ্ঞাসা করলে ওসমান বলে, ‘ মুই ময়নারে আর পাইলাম না’।
মনু বলে, ‘ক্যান তোর কি অইছে’ ?
ওসমান কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলে দিলো, ‘লাউপাতা রঙের উড়ন্ত স্বর্পে দংশন করেছে। মস্তের তালুতে মোড়ানো কেশের ফাঁকা স্থানে। ওরা তিনজন আশে-পাশে স্বর্পটা খোঁজাখুঁজি করল বটে- কিন্তু সাপ তো ওসমানের মাথায় বিষাক্ত ছোবল দিয়ে উড়ে গেছে, দেখা পাবে কোথায় ? ওরা হাতে হাতে জঙ্গল থেকে ছন ভিটায় বাহির করার আগে ওসমানের জ্ঞান বিদায় নিয়ে গঙ্গামতির চর থেকে আসমানে চলে গেছে। ওসমান বেহুশ, হুশের কোন নমুনা পাওয়া গেল না। তিনজন একাত্রিত হয়ে হাতে হাতে ধরে আবুলের বাবা শানু ঘরামীর ছনের বাসায় নিয়ে গেল। শানু ঘরামী ওসমানের অবস্থা বেহাল দেখে তড়িৎ গতিতে ঘাটের কূলে ছাউনীবিহীন নৌকার গুড়ার উপর শুয়ে জেলে ঘাটে নিয়ে আসল। হায়দার আলী নিকট সবার আগে খবরটা দিলো মনু। হায়দার আলী বাজান ওসমান বলে কিছু সামনে এগুতেই শানু ঘরামী, গনি ও রাছেল ওসমানকে নিয়ে পৌছল।
হায়দার আলী জিজ্ঞাসা করল, ‘শানু বাই মোর পোলার কি অইছে’?
শানু ঘরামী, ‘ তোমার পোলারে হাপে ঘাঁ দিছে’।
রাখাল পাড়ায় হায়দার আলীর গৃহের সামনে উঠানে কলাপাতা বিছিয়ে শুয়ে দিলো বেহুশ ওসমানকে। ওসমানের বাপে-মায় কাঁন্না-কাঁটি করে গড়া-গড়ি খাচ্ছে। রাখাল পাড়ার নারী-পুরুষ, ছেলে-মেয়ে, যুয়ান-বৃদ্ধা সবাই মিলে শান্তনা দিলো কত তার হিসাব কসানো যাবে না। চাঁনমিয়া, শানু ঘরামী আশে-পাশের গ্রাম হতে যত ওঝা, ফকির, কবিরাজ আনল তাদের শত চেষ্টা ব্যর্থ হলো। ওসমান চিরবিদায় নিয়ে গঙ্গামতির রাখাল পাড়া হতে পরলোকে গমন করল হারিয়ে যাওয়া আবুলের ডাকে সায় দিয়ে। ওসমানের মতো টক-বগে, যুয়ান-সাহসী রাখাল ইহলোক ত্যাগ করে পরলোকে গমন করার পরে রাখার পাড়ায় শোকের ছায়া নেমে আসল। সকলের প্রান ওসমান শূন্য হয়ে গেলো। রাখাল পাড়ায় শোক দিন দিন বৃদ্ধি পেতে আরাম্ভ করল। একদিকে আবুলের অকাল মৃত্যু অন্যদিকে ওসমানের স্বর্প দংশন মৃত্যু।
মনুর দুঃখ সবার চেয়ে বেশী। ময়নারে সাধি করবে কে ? তাছাড়া ওসমানের বাপে-মায় বৃদ্ধ বয়সে কার আয়-রোজগারের উপর নির্ভরশীল হবে। তাদের আর কোন ছেলে-মেয়ে জীবিত নাই। ওসমানের ছোট একটি বোন আয়শা ছিল, মাত্র তিন বছর বয়সে বেড়িবাঁধের কূয়ায় বদনা নিয়ে পানি আনতে গিয়ে কূয়ার মধ্যে পাথরের টুকরার মতো ডুবে মরে ভেসে উঠেছিল। মারা যাওয়া আয়শারে ভাসমান অবস্থা দেখেছিল আবুলের বাপ শানু ঘরামী। শানু ঘরামী সাগর থেকে পোনা মাছ ধরা ক্ষ্যান্ত দিয়ে রাখায় পাড়ায় ফিরে আসার পথে দেখেছিল। শানু ঘরামীর চোখে না পড়লে হয়তো আয়শার মরা দেহ রাখাল পাড়ার মাটিও পেত না, ভাটার স্রোতে সাগরে চলে যেত। কচি আয়শার শরীরের গোশত পটকা ও কাংগট মাছের আহার হতো, শানু ঘরামীর ধারণা। শানু ঘরামী মরা আয়শার দেহটা কোলে করে রাখাল পাড়ায় এনে হায়দার আলীর ঘরের সম্মুখে উঠানে দাঁড়িয়ে বলল,
‘মাইয়্যাডা পানি খাইয়্যা মইর্যা ভাইস্যা ওঠছে, হ্যারপরও কোন খোঁজ নাই’।
তারপর সবাই মিলে কাঁন্নাকাঁটি করে রাখাল পাড়ার গোরস্থানে মাটির তলে শুয়ে দিলো।
কয়েক দিন পরের কথা।
ওসমান মারা যাওয়ার পর গঙ্গামতির নতুন রাখাল হিসেবে মনুদের সঙ্গি হলো ওসমানের রাখ্খালী গরু-মহিষ রাখার জন্য ওসমানের বাপ হায়দার আলী নিজেই। হায়দার আলী রসিকতা লোট বটে- কিন্তু পুত্র শোকে তার আনন হতে রসিকতা চিরতরে প্রত্যাখান করল, আগমন করল মলিন্য ভাব। সমস্ত দিনে মলিন হয়ে বসে থাকে। গরু-মহিষের দ্বারে বুড়ো হায়দার আলী যেতে হয় না-শুধু নিরিবিলি জায়গায় বসে থাকে। মনু, গনি ও রাছেল মুরব্বী মেনে সর্বাত্মক সাহায্য করে থাকে। কিছুদিন এইভাবে কাটার পর একদিন মনু বলে,
‘হায়দার চাচা আমনে বুড়া মানু এমনে খালি গরু-মহিষ রাখলে সোংসার চলবে আনে’?
-‘ কি হরমু’?
গনি বলে, মোরা আমনের গরু-মহিষ দেকমু, ‘আমনে ফাঁহে ফাঁহে পোনা ধরবেন’।
হায়দার আলী না বলে দিলো। না বলবে না কেন ? তার সংসারে দু’জন মানুষ। নিজে ও বউ আর কেহ নাই। আসার সম্ভাবনা একবারেই নাই। হায়দার আলীর ছোট মেয়েটি দুনিয়াতে আগমন করার পর অভাবি সংসারে আর কোন বাড়তি জনসংখ্যার আশা ত্যাগ করে তিনি নিজেই থানা শহরে গিয়ে স্থায়ীভাবে জন্ম বিরতিকরণ স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহন করেছেন। দু’জনের সংসারে গরু-মহিষ রাখার চেয়ে বেশী কামাই করার প্রয়োজন মনে করল না হায়দার আলী।
হায়দার আলী বুড়ো বয়সে গরু-মহিষ রাখার পেশা গ্রহন করে নিল। তার বউ আঞ্জুমালা বদ মেজাজের বার বার বলে, যে ময়নার লগে ওসমানের সম্বন্ধের প্রস্তাবের কারনে নাকি ওসমানের মৃত্যু হয়েছে। আসলে কথাটা কতটা সত্য কে জানে ? আঞ্জুমালার ভাষায় বলে,
‘কপাল পোড়া মাইয়্যাডার লগে মোর পোল্যার সাধির কতা না কইলে মরত না’।
হঠাৎ একদিন আছমত আলী রাখাল পাড়ায় প্রবেশ করল। ময়না জল ভর্তি কলসি নিয়ে ঘরে ফিরছে। আছমত আলীর চোখে পড়ল। ময়না দেখতে মন্দ না। ছয়-ছোট্টর মধ্যে ভালই লাগল আছমত আলীর চোখে। তিনি মূর্তির মতো দন্ডায়মান হয়ে ময়নার দিকে চেয়ে থাকল পলকহীন দৃষ্টিতে। চেয়ে থেকে মনে মনে ময়নারে সাধি করার মনস্তাব করল। আছমত আলীর একনজরে তাকিয়ে থাকা দেখে গনির বাবা আজিজ পহলান বলল, ‘ও মিয়া আছমত বাই, ওহানে কি দেখতাছ’?
বির বির করে বলল, ‘হালার বজ্জাত মাইয়্যা দ্যাখলেই চাইয়্যা থাহে, একটা একটা হইরর্যা তিনডা বৌ মরছে, হ্যারপরও লাজ অয়নাই।
আছমত আলী নড়া-চড়া দিয়ে স্বাভাবিক হয়ে বলল, ‘কিছু না মিয়া’।
আজিজ পহলান বারান্দায় পিঁড়িতে বসে তামাক টানছে।
পহলান বলল, ‘আহ মিয়া তামাক টাইন্যা যাও’।
আছমত আলী কাছে এসে মায়া দেখিয়ে বলে,
‘দেখছিলাম মিয়া কাঞ্চনের মাইয়্যাডারে, ঐডু মাইয়্যা কলসিতে পানি আনছে, বাপে-মায় বাইচ্যা থাকলে কি আনতে দিতো’?
আজিজ পহলান উচ্চস্বরে বলল, ‘তোমার দেখছি মিয়া বাই খুব দরদ’।
মনে মনে ফিস ফিস করে বলল, ‘মাইয়্যাডার প্রতি তোমার লোভ লাগছে বুঝি ’?
আজিজ পহলান কলকিটা আছমত আলীর হাতে দিল। আছমত আলী গড় গড় করে টানতে আরাম্ভ করল। কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করে, আজিজ পহলান বলে, ‘আছমত বাই ম্যালাদিন পরে মোগো পাড়ায় আইলা, কি মনে কইর্যা’?
আছমত আলী বলল, ‘কাম কাইজ নাই হ্যাইয়্যার লইগা রোয়াপাতা দেখতে দেখতে আইলাম, তোমাগো লগে দেহা হরতে’। ছোট বৌ মরার পর মোটেও ভাল লাগে না, তিনডা বউ মোরে ছাইরা গেছে’।
তামাক টানা শেষ করে বলল, ‘এহন যাই আজিজ বাই’। আছমত আলী উঠে মনুর ঘরের সম্মুখ দিয়ে ময়নারে আর একবার দেখার জন্য চলে গেল।
আছমত আলীর বাড়ি গঙ্গামতি গ্রামের একটি ফারাকে বড়হর পাড়া গ্রামে। আছমত আলী বিত্তবান লোক। ব্যবসা বলতে কিছু নাই। শুধু কুড়ি একর জমি চাষাবাদ করে বছরে ভাল ফসল কামায়। রবি শষ্যের মরসুমে কামে লোক রেখে দুলাট দিয়ে থাকে। প্রত্যক বছর কম বেশী লাভ হয়। আছমত আলীর লোকসান হয় খুব কম- যা হয় বৌ দিয়ে। ভাল ভাল সুন্দরী দেখে পনে দিয়ে বউ আনে বটে-আসলে কয়েক বৎসর পর আছমত আলীর ঘরে থাকে না চলে যায় পরপারে। প্রথম বউটা সাধি করেছিল দশ বৎসর বয়সী নিজ গ্রামের মুবারক আলী মেয়ে সেতারাকে। সে সময় আছমত আলীর বয়স ছিল মাত্র পনের বছর। দশ বছরের মেয়ে বিয়ে করে তিনি অপরাধ করেছিল, অপরাধের শাস্তি পেয়েছিল। সেতারার বিয়ের দু’বছর পর সন্তান প্রসব করার সময় মারা গেছে বটে- তবুও নবজাতক বাঁচল না। দু’দিন মায়ের দুধের অভাবে মরে গেল। আছমত আলী বাঁচিয়ে রাখতে পারে নাই। সেতারা মারা যাওয়ার পর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই দু’নাম্বার সম্বন্ধ করল পাশের গ্রামের পরের ক্ষেতে কাজ করা কদম মালের পাঁচ সন্তানের চার নম্বর মেয়ে নুরজাহানকে। এগারো বছর বয়সী নুরজাহানকে সাধি করেছিল চার হাজার টাকা পনে দিয়ে। তিন বছর পর একদিন দুপুর বেলা শ্রাবন মাস আসমান হতে হালকা ঝড়ে তুমুল বৃষ্টি বর্শন হচ্ছে। আছমত আলী কুড়িহানে রাজহাঁস বাড়ির পিছনে বিলের মাঝে মাইন উদ্দিনের বিচলাখলার বীজ নষ্ট করছে। বাড়িতে কোন লোক না থাকার কারনে রাজহাঁস আনতে গিয়েছে নুরজাহান। রাজহাঁস গুলো নিয়ে বাড়িতে ফেরৎ আসা সম্ভব হয়েছিল বটে- জীবিত না মৃত। হাঁসগুলো পরের ক্ষেতের ধানের চারা নষ্ট করে মালিকের বাড়ি দেহে প্রান নিয়ে আসতে পারে নাই। আসমান হতে বজ্রপাত হয়ে নুরজাহান ও হাঁসগুলো প্রান শূন্য দেহ নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। নুরজাহানের একটি পা মাটি হতে দশ ইঞ্চির মতো হাওয়ায়। এক পা মাটিতে রেখে অন্য পা দিয়ে সামনে অগ্রসর হবে- ঠিক এমন মুহূর্তে বজ্রপাত হইল। হাঁসগুলোর কোনটার পা নুরজাহানের মতো, কোনটার লম্বা গলা পিছনে, কোনটা তীক্ষ্র চঞ্চু নরম মাটিতে পুতা, কোনটার পাখা ঘরের বেড়ায় ঝুলানো কাগজের পাখির ছবির মতো মেলা, মনে হয় হাঁসটা এখনই উড়াল দিবে।
মনু বলে, ‘ক্যান তোর কি অইছে’ ?
ওসমান কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলে দিলো, ‘লাউপাতা রঙের উড়ন্ত স্বর্পে দংশন করেছে। মস্তের তালুতে মোড়ানো কেশের ফাঁকা স্থানে। ওরা তিনজন আশে-পাশে স্বর্পটা খোঁজাখুঁজি করল বটে- কিন্তু সাপ তো ওসমানের মাথায় বিষাক্ত ছোবল দিয়ে উড়ে গেছে, দেখা পাবে কোথায় ? ওরা হাতে হাতে জঙ্গল থেকে ছন ভিটায় বাহির করার আগে ওসমানের জ্ঞান বিদায় নিয়ে গঙ্গামতির চর থেকে আসমানে চলে গেছে। ওসমান বেহুশ, হুশের কোন নমুনা পাওয়া গেল না। তিনজন একাত্রিত হয়ে হাতে হাতে ধরে আবুলের বাবা শানু ঘরামীর ছনের বাসায় নিয়ে গেল। শানু ঘরামী ওসমানের অবস্থা বেহাল দেখে তড়িৎ গতিতে ঘাটের কূলে ছাউনীবিহীন নৌকার গুড়ার উপর শুয়ে জেলে ঘাটে নিয়ে আসল। হায়দার আলী নিকট সবার আগে খবরটা দিলো মনু। হায়দার আলী বাজান ওসমান বলে কিছু সামনে এগুতেই শানু ঘরামী, গনি ও রাছেল ওসমানকে নিয়ে পৌছল।
হায়দার আলী জিজ্ঞাসা করল, ‘শানু বাই মোর পোলার কি অইছে’?
শানু ঘরামী, ‘ তোমার পোলারে হাপে ঘাঁ দিছে’।
রাখাল পাড়ায় হায়দার আলীর গৃহের সামনে উঠানে কলাপাতা বিছিয়ে শুয়ে দিলো বেহুশ ওসমানকে। ওসমানের বাপে-মায় কাঁন্না-কাঁটি করে গড়া-গড়ি খাচ্ছে। রাখাল পাড়ার নারী-পুরুষ, ছেলে-মেয়ে, যুয়ান-বৃদ্ধা সবাই মিলে শান্তনা দিলো কত তার হিসাব কসানো যাবে না। চাঁনমিয়া, শানু ঘরামী আশে-পাশের গ্রাম হতে যত ওঝা, ফকির, কবিরাজ আনল তাদের শত চেষ্টা ব্যর্থ হলো। ওসমান চিরবিদায় নিয়ে গঙ্গামতির রাখাল পাড়া হতে পরলোকে গমন করল হারিয়ে যাওয়া আবুলের ডাকে সায় দিয়ে। ওসমানের মতো টক-বগে, যুয়ান-সাহসী রাখাল ইহলোক ত্যাগ করে পরলোকে গমন করার পরে রাখার পাড়ায় শোকের ছায়া নেমে আসল। সকলের প্রান ওসমান শূন্য হয়ে গেলো। রাখাল পাড়ায় শোক দিন দিন বৃদ্ধি পেতে আরাম্ভ করল। একদিকে আবুলের অকাল মৃত্যু অন্যদিকে ওসমানের স্বর্প দংশন মৃত্যু।
মনুর দুঃখ সবার চেয়ে বেশী। ময়নারে সাধি করবে কে ? তাছাড়া ওসমানের বাপে-মায় বৃদ্ধ বয়সে কার আয়-রোজগারের উপর নির্ভরশীল হবে। তাদের আর কোন ছেলে-মেয়ে জীবিত নাই। ওসমানের ছোট একটি বোন আয়শা ছিল, মাত্র তিন বছর বয়সে বেড়িবাঁধের কূয়ায় বদনা নিয়ে পানি আনতে গিয়ে কূয়ার মধ্যে পাথরের টুকরার মতো ডুবে মরে ভেসে উঠেছিল। মারা যাওয়া আয়শারে ভাসমান অবস্থা দেখেছিল আবুলের বাপ শানু ঘরামী। শানু ঘরামী সাগর থেকে পোনা মাছ ধরা ক্ষ্যান্ত দিয়ে রাখায় পাড়ায় ফিরে আসার পথে দেখেছিল। শানু ঘরামীর চোখে না পড়লে হয়তো আয়শার মরা দেহ রাখাল পাড়ার মাটিও পেত না, ভাটার স্রোতে সাগরে চলে যেত। কচি আয়শার শরীরের গোশত পটকা ও কাংগট মাছের আহার হতো, শানু ঘরামীর ধারণা। শানু ঘরামী মরা আয়শার দেহটা কোলে করে রাখাল পাড়ায় এনে হায়দার আলীর ঘরের সম্মুখে উঠানে দাঁড়িয়ে বলল,
‘মাইয়্যাডা পানি খাইয়্যা মইর্যা ভাইস্যা ওঠছে, হ্যারপরও কোন খোঁজ নাই’।
তারপর সবাই মিলে কাঁন্নাকাঁটি করে রাখাল পাড়ার গোরস্থানে মাটির তলে শুয়ে দিলো।
কয়েক দিন পরের কথা।
ওসমান মারা যাওয়ার পর গঙ্গামতির নতুন রাখাল হিসেবে মনুদের সঙ্গি হলো ওসমানের রাখ্খালী গরু-মহিষ রাখার জন্য ওসমানের বাপ হায়দার আলী নিজেই। হায়দার আলী রসিকতা লোট বটে- কিন্তু পুত্র শোকে তার আনন হতে রসিকতা চিরতরে প্রত্যাখান করল, আগমন করল মলিন্য ভাব। সমস্ত দিনে মলিন হয়ে বসে থাকে। গরু-মহিষের দ্বারে বুড়ো হায়দার আলী যেতে হয় না-শুধু নিরিবিলি জায়গায় বসে থাকে। মনু, গনি ও রাছেল মুরব্বী মেনে সর্বাত্মক সাহায্য করে থাকে। কিছুদিন এইভাবে কাটার পর একদিন মনু বলে,
‘হায়দার চাচা আমনে বুড়া মানু এমনে খালি গরু-মহিষ রাখলে সোংসার চলবে আনে’?
-‘ কি হরমু’?
গনি বলে, মোরা আমনের গরু-মহিষ দেকমু, ‘আমনে ফাঁহে ফাঁহে পোনা ধরবেন’।
হায়দার আলী না বলে দিলো। না বলবে না কেন ? তার সংসারে দু’জন মানুষ। নিজে ও বউ আর কেহ নাই। আসার সম্ভাবনা একবারেই নাই। হায়দার আলীর ছোট মেয়েটি দুনিয়াতে আগমন করার পর অভাবি সংসারে আর কোন বাড়তি জনসংখ্যার আশা ত্যাগ করে তিনি নিজেই থানা শহরে গিয়ে স্থায়ীভাবে জন্ম বিরতিকরণ স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহন করেছেন। দু’জনের সংসারে গরু-মহিষ রাখার চেয়ে বেশী কামাই করার প্রয়োজন মনে করল না হায়দার আলী।
হায়দার আলী বুড়ো বয়সে গরু-মহিষ রাখার পেশা গ্রহন করে নিল। তার বউ আঞ্জুমালা বদ মেজাজের বার বার বলে, যে ময়নার লগে ওসমানের সম্বন্ধের প্রস্তাবের কারনে নাকি ওসমানের মৃত্যু হয়েছে। আসলে কথাটা কতটা সত্য কে জানে ? আঞ্জুমালার ভাষায় বলে,
‘কপাল পোড়া মাইয়্যাডার লগে মোর পোল্যার সাধির কতা না কইলে মরত না’।
হঠাৎ একদিন আছমত আলী রাখাল পাড়ায় প্রবেশ করল। ময়না জল ভর্তি কলসি নিয়ে ঘরে ফিরছে। আছমত আলীর চোখে পড়ল। ময়না দেখতে মন্দ না। ছয়-ছোট্টর মধ্যে ভালই লাগল আছমত আলীর চোখে। তিনি মূর্তির মতো দন্ডায়মান হয়ে ময়নার দিকে চেয়ে থাকল পলকহীন দৃষ্টিতে। চেয়ে থেকে মনে মনে ময়নারে সাধি করার মনস্তাব করল। আছমত আলীর একনজরে তাকিয়ে থাকা দেখে গনির বাবা আজিজ পহলান বলল, ‘ও মিয়া আছমত বাই, ওহানে কি দেখতাছ’?
বির বির করে বলল, ‘হালার বজ্জাত মাইয়্যা দ্যাখলেই চাইয়্যা থাহে, একটা একটা হইরর্যা তিনডা বৌ মরছে, হ্যারপরও লাজ অয়নাই।
আছমত আলী নড়া-চড়া দিয়ে স্বাভাবিক হয়ে বলল, ‘কিছু না মিয়া’।
আজিজ পহলান বারান্দায় পিঁড়িতে বসে তামাক টানছে।
পহলান বলল, ‘আহ মিয়া তামাক টাইন্যা যাও’।
আছমত আলী কাছে এসে মায়া দেখিয়ে বলে,
‘দেখছিলাম মিয়া কাঞ্চনের মাইয়্যাডারে, ঐডু মাইয়্যা কলসিতে পানি আনছে, বাপে-মায় বাইচ্যা থাকলে কি আনতে দিতো’?
আজিজ পহলান উচ্চস্বরে বলল, ‘তোমার দেখছি মিয়া বাই খুব দরদ’।
মনে মনে ফিস ফিস করে বলল, ‘মাইয়্যাডার প্রতি তোমার লোভ লাগছে বুঝি ’?
আজিজ পহলান কলকিটা আছমত আলীর হাতে দিল। আছমত আলী গড় গড় করে টানতে আরাম্ভ করল। কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করে, আজিজ পহলান বলে, ‘আছমত বাই ম্যালাদিন পরে মোগো পাড়ায় আইলা, কি মনে কইর্যা’?
আছমত আলী বলল, ‘কাম কাইজ নাই হ্যাইয়্যার লইগা রোয়াপাতা দেখতে দেখতে আইলাম, তোমাগো লগে দেহা হরতে’। ছোট বৌ মরার পর মোটেও ভাল লাগে না, তিনডা বউ মোরে ছাইরা গেছে’।
তামাক টানা শেষ করে বলল, ‘এহন যাই আজিজ বাই’। আছমত আলী উঠে মনুর ঘরের সম্মুখ দিয়ে ময়নারে আর একবার দেখার জন্য চলে গেল।
আছমত আলীর বাড়ি গঙ্গামতি গ্রামের একটি ফারাকে বড়হর পাড়া গ্রামে। আছমত আলী বিত্তবান লোক। ব্যবসা বলতে কিছু নাই। শুধু কুড়ি একর জমি চাষাবাদ করে বছরে ভাল ফসল কামায়। রবি শষ্যের মরসুমে কামে লোক রেখে দুলাট দিয়ে থাকে। প্রত্যক বছর কম বেশী লাভ হয়। আছমত আলীর লোকসান হয় খুব কম- যা হয় বৌ দিয়ে। ভাল ভাল সুন্দরী দেখে পনে দিয়ে বউ আনে বটে-আসলে কয়েক বৎসর পর আছমত আলীর ঘরে থাকে না চলে যায় পরপারে। প্রথম বউটা সাধি করেছিল দশ বৎসর বয়সী নিজ গ্রামের মুবারক আলী মেয়ে সেতারাকে। সে সময় আছমত আলীর বয়স ছিল মাত্র পনের বছর। দশ বছরের মেয়ে বিয়ে করে তিনি অপরাধ করেছিল, অপরাধের শাস্তি পেয়েছিল। সেতারার বিয়ের দু’বছর পর সন্তান প্রসব করার সময় মারা গেছে বটে- তবুও নবজাতক বাঁচল না। দু’দিন মায়ের দুধের অভাবে মরে গেল। আছমত আলী বাঁচিয়ে রাখতে পারে নাই। সেতারা মারা যাওয়ার পর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই দু’নাম্বার সম্বন্ধ করল পাশের গ্রামের পরের ক্ষেতে কাজ করা কদম মালের পাঁচ সন্তানের চার নম্বর মেয়ে নুরজাহানকে। এগারো বছর বয়সী নুরজাহানকে সাধি করেছিল চার হাজার টাকা পনে দিয়ে। তিন বছর পর একদিন দুপুর বেলা শ্রাবন মাস আসমান হতে হালকা ঝড়ে তুমুল বৃষ্টি বর্শন হচ্ছে। আছমত আলী কুড়িহানে রাজহাঁস বাড়ির পিছনে বিলের মাঝে মাইন উদ্দিনের বিচলাখলার বীজ নষ্ট করছে। বাড়িতে কোন লোক না থাকার কারনে রাজহাঁস আনতে গিয়েছে নুরজাহান। রাজহাঁস গুলো নিয়ে বাড়িতে ফেরৎ আসা সম্ভব হয়েছিল বটে- জীবিত না মৃত। হাঁসগুলো পরের ক্ষেতের ধানের চারা নষ্ট করে মালিকের বাড়ি দেহে প্রান নিয়ে আসতে পারে নাই। আসমান হতে বজ্রপাত হয়ে নুরজাহান ও হাঁসগুলো প্রান শূন্য দেহ নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। নুরজাহানের একটি পা মাটি হতে দশ ইঞ্চির মতো হাওয়ায়। এক পা মাটিতে রেখে অন্য পা দিয়ে সামনে অগ্রসর হবে- ঠিক এমন মুহূর্তে বজ্রপাত হইল। হাঁসগুলোর কোনটার পা নুরজাহানের মতো, কোনটার লম্বা গলা পিছনে, কোনটা তীক্ষ্র চঞ্চু নরম মাটিতে পুতা, কোনটার পাখা ঘরের বেড়ায় ঝুলানো কাগজের পাখির ছবির মতো মেলা, মনে হয় হাঁসটা এখনই উড়াল দিবে।
মাইন উদ্দিনের মাসিক মাহিনার মায়েন্দার মোস্তফা লক্ষ্য করে দেখল আছমত আলীর বউটা বেশ কিছু সময় একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। আসলে ঘটনাটা কি ? মোস্তফার ধারণা হলো বজ্রপাত হতে পারে। ধীরে ধীরে সামনে অগ্রসর হয়ে নিশ্চিত হলো ধারণা সত্য। মোস্তফা পরের বউ নুরজাহানের শরীরে স্পর্শ করলেই মাটিতে ঢলে পরে গেল। মোস্তফা তাড়াতাড়ি আছমত আলীর বাড়ি গিয়ে দেখল জনশুন্য বাড়ি সংবাদটা দিবে কার কাছে ?
কিছু সময় পর আছমত আলী কোলা বা বিল থেকে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে দেখল উঠানে মানুষ জনের কমতি নাই। নুরজাহার চিরতরে চলে গেল পরপারে। দাফন করল বাড়ির সম্মুখে বড় পেয়ারা গাছটার নিচে বড় বউয়ের পাশে। বড় বৌ সেতারা মরার ভয়তে আছমত আলী নুরজাহানের গর্তে সন্তান জন্ম দেয় নাই। আছমত আলী উপরওয়ালার প্রতি অভিমান করে এগারো বছরে আর সাধি করে নাই। নুরজাহার মারা যাবার পর এগারো বছর অতিবাহিত হলো বারো বছরে পর্দাপন করল। ঐ বৎসর আছমত আলী একই এলাকার সাত গ্রাম তফাতে খাজুরা গ্রামের মিজান ফরাজীর মাইয়া আফিয়াকে সাধি করেছে। আফিয়া অবিবাহিত ছিল তা নয় সাধি হয়েছিল বটে-স্বামী বৎসর তিনে পরে বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ, আর ফিরে আসেনি। পাঁচ বছর গত হয়ে গেল। দীর্ঘ দিন স্বামী আলতাবের জন্য পথ চেয়ে থেকে অবশেষে আফিয়া আমছত আলীর বউ হতে রাজি হয়ে গেল। আছমত আলীর কাছ থেকে তিন হাজার টাকা পোনে নিয়ে সাধি দিলো মিজান ফরাজী কন্যা আফিয়াকে।
আছমত আলী আফিয়াকে সাধি করে পিছনের দুঃখ ভুলে নতুন আশা-উদ্দিপনা সঞ্চয় করে সংসার আরাম্ভ করল। আফিয়ার বয়স আঠারো বছর, আছমত আলী বয়স ত্রেত্রিশ বছর বটে- তবুও মিল ছিল দাম্পত্য জীবনে। সুখ-শান্তি বিরাজ করছিল আছমত আলী সংসারে তবুও আছমত-আফিয়ার মনে দুঃখ দূর হলো না। কারণ আফিয়ার অন্তস্বত্তা হবার সম্ভাবনা নাই। সম্বন্ধের দু’বছর পার হয়ে যাওয়ার পরও অর্ন্তস্বত্তা হলো না। তাই আছমত আলী একদিন বউরে নিয়ে তের কিলোমিটার দূরত্ব শহরের হাসপাতালে গিয়েছিল। হাসপাতালের কর্মরত ডাক্তার চেক করে বলে দিলো আফিয়া মা হবার সম্ভবনা চিরতরে হারিয়ে ফেলেছে। সন্তান শূন্য ব্যাথা বুকের মধ্যে নিয়ে দশ বছর পার হয়ে গেলো।
একদিন আছতম আলী নিকটবর্তী হাট থেকে ফিরে কষ্টের তাড়নায় বলেছিল-
‘পোলাপাইন না থাকলে এই বয়সে ক্যামনে হাট বাজার করে’?
বউ এর লগে কথার কাটাকাটির এক পর্যায়ে ক্লান্ত শরীরে চরা মেজাজে বলল-
‘একটা পোড়া কপাইল্যা বিয়া কইর্যা পোলাপাইন পাইলাম না, না যানি বুড়ো বয়সে কত কষ্ট কপালে আছে’?
একে তো সন্তান না হবার ব্যাথা আরাব স্বামীর মুখে পোড়া কপালী শুনে আফিয়া নিজেকে সামাল দিতে পারে নাই। রাত্র যখন গভির হলো আছমত আলী ঘুমের ঘোরে নাক ডাকা আরাম্ভ করল। আফিয়া বুঝল স্বামী ঘুমে বেহুশ। স্বামীকে একা বিছানায় ঘুমে রেখে ঘরের দাওয়ার সাথে ভিজা কাপড়-চোপড় শুকানোর জন্য টানানো রশিটা খুলে আত্ম,হত্যার জন্য প্রস্তুতি নিল। ঘরের পিছনের বাঁকা পেয়ারা গাছটার হাত দশে উপরে উঠে রশির এক মাথা বেঁধে অন্য মাথা নিজের গলার সাথে বেঁধে লাফিয়ে পরে। প্রান পাখি দেহ থেকে উড়াল দিয়ে প্রান শূন্য দেহ নিয়ে জিহ্বা বাহির করে গলা বেঁকে ঝুলে রইল।
রাত্র তিনটার দিকে আছমত আলী মোর ফিরে আফিয়ার টের না পেয়ে শিয়াশলাই দিয়ে টুকরি জ্বালিয়ে দেখল আফিয়া ঘরে নাই। কয়েকটা ডাক দিলো বটে- কোন সারা শব্দ নাই। টুকরি নিয়ে একটু সামনে এগুতেই দেখল পিচনের দরজা খোলা। দরজার কাছে গিয়ে বাহিরে হাতের টুকরির আলোতে দেখল আফিয়া পেয়ারা গিলতে গিলতে ঝুলে আছে। আছমত আলী আফিয়ার মরা ঝুলন্ত দেহের নিচে গিয়ে নয়ন অশ্র“ ছেড়ে বলল, ‘বউডা কামডা হরলি কি, মোরে এতিম করে গ্যালি কৈ ’?
সত্যিই কি আফিয়া আছমত আলীকে এতিম করেছে-তা আছমত আলী জানে না। বউ কখনও এতিম করতে পারে- তাহা কে জানে ?
আছমত আলী ডাক চিৎকার শুনে আশে-পাশের প্রতিবেশীরা আসল। আছমত আলী ঝুলন্ত আফিয়াকে নামানোর জন্য বারোং বার চেষ্টা করিল বটে- তারপরও নামাতে পারল না, প্রতিবেশী লোকজনের বাঁধার কারনে। নামালে পুলিশ ঝামেলা করতে পারে- ওদের ধারণা। সকাল বেলা থানা পুলিশ অফিসার লাশ নামিয়ে মর্গে নিয়ে গলো। বিকালে মর্গে থেকে এনে আছমত আলীর বাড়ির সামনে পেয়ারা গাছের পূর্বের মরা দুই বউয়ের পাশে চিরতরে বিদায় দিয়ে শুয়ে দিলো। সহজে শুয়ে দিতে পারে নাই। পুলিশকে মিটমাট করতে ঝামেলা কম হয়নি।
দিন দুই পর আছমত আলী রাখাল পাড়ায় আসল সাঁজের বেলা। চাঁনমিয়া ঘরের সম্মুখে দাঁড়িয়ে তিনি বাড়ি আছেন কিনা জিজ্ঞাসা করল। চাঁনমিয়া জাল পাততে বঙ্গোপসাগরের মোহনার খালে গেছে বলে দিলো স্ত্রী ঝামেলা বিবি। আছমত আলী তারপর ধীরে ধীরে উঠানে এসে দাঁড়িয়ে রইল। ঝামেলা বিবি আপত্তি করে বলল, ‘নেবাইজান বহেন’। আছমত আলী তামাক থাকলে বসবে বলল। ঝামেলা বিবি চার খুড়া বিশিষ্ট একটি ঝলচকি বারান্দায় বসতে বলল। আছমত আলী বসে পড়ল। ঝামেলা বিবি খোলায় টালা তামাক, সাদা কাগজ ও দিয়াশলাই এনে বলল, ‘নেবাইজান বানাইয়্যা খান’।
আছমত আলী একটি বিড়ি বানাতে এক টুকরা কাগজ সম পরিমান গুড়া তামাক লয়ে মুড়ে এক মাথা মোটা আর মাথা চিকন বিড়ির মতো বানাল। চিকন মাথা মুখে নিয়ে দিয়াশলাই দিয়া জ্বালিয়ে টানতে টানতে ঝামেলা বিবি কাছে বলে চলে গেল মনুর কুটিরে, ‘ওবেডা মনুন্যা বাড়ি আছে’?
ময়না দরজার কাছে এসে বলে দিলো বাড়ি নাই। আছমত আলী অযথা বাড়তি কথা বলল- ‘মনুন্যা কাম কাইজ করে কি’?
ময়না বলে, ‘গরু-মহিষ রাহে’।
আর কথা না বলে চলে গেল। আছমত আলীর ভাব-ভঙ্গি ভাল না ময়নার বোঝার বাকি নাই। গঙ্গামতির রাখাল পাড়ার সবাই আছমত আলীকে ডরায়। মুখ খুলে কেহ কিছু বলতে পারে না। এই জন্যই ময়না কারো নিকট কিছু বলেনি। ময়না বির বির করে বলল-
‘বুড়া হইলা স্বভাব ভাল হরতে পারলা না, আল্লায় কবে ভাল বানাইবে ভাবতে আছি’।
---------------*******-----------------
No comments