গঙ্গামতির রাখাল-(পর্ব-পাঁচ)

                 গঙ্গামতির রাখাল-(পর্ব-পাঁচ)
Novel Cover Photo
Novel Cover Photo
ঙ্গামতির রাখার পাড়ার একটু পূর্ব পার্শ্বে জেলে ঘাটে শত শত জেলেদের প্রয়োজন মিটানোর জন্য ছোট একটি চা-পান-বিড়ির পণ্যশালা। শুধু পান-বিড়ির পণ্যশালা না, ইঞ্চিন চালিত নৌকা-ট্রলারের জ্বালানি তেল পাওয়া যায়। সমস্ত রাত্র জেলে ঘাটে দু’-চারটি নৌকা বাঁধা থাকে। ডানো দুধের বাটায় করে কয়েক গোছা পাটের সুতলী মুড়ে বাটার মাঝখানে চুংগির মধ্যে ডুকিয়ে, কেরোসিন তো ভিতরে আছেই। জ্বলিতেছে দাউ-দাউ না, টিপ-টিপও না, মাঝা-মাঝি। চা এর দোকানে টুকরি না, হারিকেন নিভু-নিভু জ্বলছে। চাঁনমিয়া দুইশত পয়সার একটি চা পান করছে। আছমত আলী পিছনে এসে- ‘চাঁনবাই একটা তামাক খাওয়াইবা’?
-‘হ ....খাবা ! খাও’।
চাঁনমিয়া দোকানদার পনুকে বলে দিলো একটা বিড়ি দিতে। আছমত আলী বিড়ি ধরিয়ে টানতে টানতে বলে, ‘চানবাই বাড়ি যাইবা না ’? 
-‘হ.... যামু ! ক্যান’? 
-‘তোমার লগে আলাপ আছে ’।
চাঁনমিয়া ও আছমত আলী পণ্যশালা হতে উঠে ঘোর অন্ধকার নিজের শরীর নিজে দেখা যায় না এমন রাত্রে বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে রহনা হলো। আছমত কি কথা বলবে, চাঁনমিয়া কি জানে ? জিজ্ঞাসা করল কি কইবা মিয়াবাই কও। আছমত আলী আবেগ প্রকাশ করে বলল-
‘চানবাই তুমি একটা কাম ঠিক হরতে আছো না’।
- ‘কি কাম’?
- তোমার ভাইর মাইয়্যারে সাধি দেও না ক্যান’?
চাঁনমিয়া দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল- ‘সাধি তো দিমু মিয়া টাহা পয়সার ঘাটতি তো আছেই, তারপর এতিম মাইয়্যা সাধি হরবে কেডা ?
আছমত আলী বলে, ‘হেইয়্যা তোন একটা কথা’।

কথার ফাঁকে রাস্তা শেষ হয়ে গেলো। চাঁনমিয়া বাড়ি ডোকার রাস্তায় দাঁড়াল। আছমত আলী আরো কিছু বলবে মনস্তাব করল বটে-কিন্তু চাঁনমিয়া অন্য কথা বলে প্রসঙ্গে ঘুরাল। আছমত আলী যেন আজকের রাতটা চাঁনমিয়া বাড়ি থেকে যায়। আছমত আলী রাজি না হয়ে সম্মুখে এগুতে আরাম্ভ করল- ঘোর তমস্রা ভেদ করে। দু’একটি জোনাকি পোঁকা নাকের ডগায়, কানের গোড়ায়, কালো কেশের মাথায়, গায়ের লম্বা জামায় পরে হালকা আলো প্রজ্জ্বলিত করে রাস্তা চলতে সাহায্য করছে। অন্ধকার রাত্রে জোনাকি পোঁকা সাহায্যে চলে গেলো। ঠিক আছে ঝামেলা হয় নাই বটে- সমস্যা আছে। রমনীবিহীন বাড়ি। বাহিরে ডাকলে প্রদীপ জ্বালাবে পঁচাশি বছরের বুড়ো জননী। দরজা খুলতে দশ মিনিটের কম সময় লাগবে না। বুড়ো জননী কোমড় সোজা হয়ে হাটার কাজটি সহজ না। হাতে চিকন বাঁশের গোড়ালী সহ বাঁকল কাটা বাজ লাঠিতে হাটিতে হয় ভর করে। তারপর আবার সমস্ত শরীরের গিড়াগুলো চুরমার করছে। একবার বিছানায় শুলে মন চায় না উঠতে। করবে কি পোলার বউ দেড় জোড়া পেয়ারা গাছের নিচে কলহহীনভাবে ঘুমিয়ে আছে নিশ্চিন্তে। স্বামী আছমত আলী কখন বাড়ি আসবে সে চিন্তা ওদের কারো নেই মোটেও। সমস্ত দায়-দায়িত্ব বুড়ো জননীর ঘাড়ে। কখন আসবে চল্লশি বছর বয়সী বাছা ফিরে ঘর। যা হোকে কষ্ট যতই হোক দরজা খুলতে হবে তাকে। দরজা খুলে দিলো প্রবেশ করল ঘরে। খানা-পিনা বেড়ে দেবার মতো সাধ্য নাই এতো রাত্রে বুড়ো জননীর। পুরুষ মানুষ বেড়ে খাওয়া একটু কষ্ট। খিদে তো আর কষ্ট মানে না। আছমত আলী এক থালা ভাত নিয়ে কৈ মাছের ঝোল দিয়ে খাইল। বিছানা এলোমেলো মনে হয় সাপে আর ভেজিতে যুদ্ধ করেছে। এলোমেলো করে সাপ নিজের গর্তে না ইঁদুরের গর্তে আর ভেজি গহিন জঙ্গলে বিষের জ্বালা নিপাত করতে বিষমুক্ত পাতা গিলতে গেছে।

আছমত আলী বিছানাটা ঠিক করে শুয়ে শুয়ে ভাবছে সাধি ছাড়া আর চলবে না। সাধি তো করবে, করা তো সহজ.......... কিন্তু ......। কন্যা দিবে কে ? বউ তিনটি মারা গেছে-ঝামেলা নাই। আফিয়া আত্মহত্যা করেছে দোষ তো আছমত আলীর না, লোকে দোষী সাবস্ত করবে কাকে ? যতই করল চিন্তা হিসাব মিলল ময়না। ময়না বাপ-মা মরা এতিম, অসহায়, গরিব মেয়ে বিয়ে করবে কে-  আছমত ছাড়া। ধারণাটি কতটা সত্য তা কে জানে ? আছমত আলী ঘুমিয়ে পরছে কখন নিজেও টের পাইনি।

আছমত আলীর মতলব যা করেছে-তা চাঁনমিয়ার বোঝার বাকি নাই। ঝামেলা বিবির সাথে আলাপ করল। ঝামেলা বিবি ভাবল তিনি শান্ত মনের মানুষ-মেজাজ আবার একটুতেই কড়া হয়ে যায়। ময়না কচি মেয়ে উপর্যুক্ত বয়স হয়নি সাধির। চল্লিশ বছর পার পাওয়া পাত্রের সাথে বিবাহ খানিক খানি কথা না। স্বচিন্তার শেষ প্রান্তে পৌছতে না পেরে সহাচিত্তে বলল,
‘আছমত আলী ভাব-সাপ হরে কি দেহি লই, ওনার লগে ক্ষেপাগিরি করা ভাল অবেনা’।

বউ স্বামী আধা পেডি খেয়ে- পুরানো গেওয়া সরু কচার পাতানো খট খট করা চকিতে ঘুমিয়ে পড়ল। সাজু-মজু আগেই ঘুমিয়েছে তালপাতার বেড়া দেওয়া বারান্দায়। চাঁনমিয়ার কাঁশা কাঁশির জ্বালায়, ঝামেলার চোখ আপনে বুঝে আসে বটে- কিন্তু ঘুমাতে পারে না। কাঁশে আর কাঁশে খক্কর খক্কর খ....খ....খ... করে। মনে হয় এখনি ধম বন্ধ হয়ে যাবে, তবুও যায় না। হঠাৎ থেমে যায়, এই মুহূর্তে বলে, ‘ঝামেলা একটা তামাক দে’।
ঝামেলার ঘুমে স্বস্তি নাই, আবার তামাক। চেচিয়ে গায়ের উপর ছিড়া কাথাটা ফেলে দিয়ে- বেড়ার সাথে রশি দিয়ে বাঁধা তক্তার উপর খোলায় টালা গুড়া করা তামাকের বাডা এনে বলে, ‘খাও মরণের খাওয়া খাও’।
চাঁনমিয়ার কাঁশটা রাত্রে তেজে বেশী, বলে কি ?
‘ ফিরর‌্যা কথা কইলে জানে মাইর‌্যা হালামু’। 
ঝামেলা বলে, ‘হেইলে তো জানে বাইচ্যা যাই-যত অশান্তি ! আর ভালো লাগে না’।
চাঁনমিয়া কড়া বিটখিট্টা ভাষায় গালি দিয়ে বলে, ‘ভালো না লাগলে য্যামনে পারো হ্যামনে যা ’।

রাত্রি কম না ঝামেলা বিবি কথা না থামালে স্বামীর সাথে লেগে যাবে আরো জোড়ালো। নিজে চুপ করে অন্য জায়গায় নামাজের ওগলা বিচিয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে গেল।

দিনের শেষে রাত্র আসল। রাতের পরে সকাল। মনুর ঘুম ভাঙ্গার পূর্বে ময়নার ঘুম চোখের পাতা মেলে দিয়ে চলে গেল রাতের সাথে বন্ধু হয়ে। ময়না হাঁস-মুরগী থাকার মাটির তৈরী ক্ষোপের দরজা কড়াই কাঠের পাতলা তক্তটা- পেল মাটি বালু মিশানো উঠানে। চোখ বুলিয়ে দেখল হাঁস-মুরগীর ক্ষোপ খোলা- সন্নিবেষ্টিত হয়ে দেখল একটিও নাই। কয়েকটি লোম পরে আছে। ময়নার বোঝার বাকি নাই-হাঁস-মুরগী কোথায় গেছে ? ঘরে ডুকে মনুরে ডাক দিয়ে বলল,
‘বাইয়্যা লইয়্যা গেছে চোরে”
মনু চোখ খুলে ময়নার চোখে ছল ছল জল দেখে জিজ্ঞাসা করল, ‘কি লইয়্যা গেছে’?
ময়না বলে, ‘আস মুরা একটাও খোপে নাই’।

মনু শোয়া হতে ঝট-পট উঠে ক্ষোপের নিকট গিয়ে দেখল কয়েকটি লোম আর ক্ষোপের মধ্যে কয়েক ফালা পিয়াজ কাটা। মনু কাটা পিয়াজের ফালা দেখে কিছুই বোঝেনি। কয়েক টুকরা হাতে নিয়ে চাঁনমিয়ার কাছে জানতে চাইল কাটা পিয়াজ কেন ?
চাঁনমিয়া বলল, ‘কাটা পিইজের বন্ধে হাস-মুরা ডাক দিতে পারে না’।

যারা চুরি করে তারা ছাড়া কে জানে ? মনু দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে শেষ হয়ে গেছে সব বলে মূর্ছা খেয়ে মাটিতে পরে গেল। চাঁনমিয়া, ঝামেলা ও ময়না মিলে তালপাতার বাতাস করে মাথায় জল দিয়ে জ্ঞান আনল, তখন গায়ের হাতাকাটা গেঞ্জিটা লোনা জলে ভিজে টপটপ পরছে ঘাম। খোঁজা খুঁজি করল কম না- পাওয়া গেল না সন্ধান কোথাও কোন কালে। নিকটস্থ হাটে খোঁজ করেছিল চার হাট চোরা বিক্রি করতে পারে। মনু চাচা চাঁনমিয়ার সাথে কষ্টে পরে বলে,
‘চাচা মনডা চায় গ্রাম ছাইড়া কোনহানে যাইয়্যা খয়রাত কইর‌্যা মানের দ্বারে দ্বারে হাত পাইতা খাই-এহানের মানুষ বেইমান। বেইমান না হইলে মোর বোইনের হাস-মুরা কয়ডা নিতে পারে চুরি হরইর‌্যা’?
মনুর জানাছিল না যেখানে যাবে অভাব-দুঃখ-কষ্ট সাথে যাবে-মনুরে ছাড়বে না।
চাঁনমিয়া জানত তাই বলল, ‘লাভ নাই হালার দুখ্য কষ্ট লগে লগে যাইবে’।  

মনু গঙ্গামতির চরে গরু-মহিষ রাখতে চরে গেল। পান্ত ভাত পেটে পরল না। সূর্যটা ঠিক মাথার উপর উঠতে ঘন্টা খানিক বাকি। পেটে ক্ষুধা লাগল কম না। মনু গনিরে বলে ওরা সবাই বড় কেওড়া গাছে প্যাঁচানো লতায় হিউজ পরিমান ‘ভাওয়ালফল’ জন্মে আছে। ভাওয়ালফল খেতে মিষ্টি না, নোনতা। ক্ষুধা বারণ হবে না জানে-সময় কাটবে সেটাই কথা। লতাফল ‘ভাওয়াল’ গিলতে গিলতে সূর্য মাথার উপরে একটু পশ্চিম আসমানে ঢলে পরেছে। গরু-মহিষ বিশাল ছন ভিটার ফাঁকে ফাঁকে শুয়ে আছে। চলে আসল ওরা রাখাল পাড়ায় দুপুরের খানা গিলতে।
রাখাল পাড়ার এক কোনে বড় শিমুল গাছটার বাঁকলে চাঁনমিয়া ও ঐ গ্রামের আছমত আলী  বসে কথা বলে গোপন কথা শোনা যায় না। মনু ঘরের বাঁশের দাওয়ায় ঝুলানো পড়নের আধা নতুন কাপড়টা নিয়ে বেড়িবাঁধের ঘোলা জলের কূয়ায় গোসল করতে চলে গেলো। যেটা হাসেম জোমাদ্দার বর্ষাকালে কিনে দিয়েছে পঞ্চাশ টাকায়। গলাজলে নেমে একটি ডুব দিল-পরের ডুবটা দেবার আগে মাথার লালচে চুলে নাড়া দিলো জোরেসোরে। কয়েকটি চুল উঠে আসল হাতের তালুতে। আহা একি এই বয়সে চুল উঠে নাকি ? উঠবে না কেন চিন্তার কোন কমতি আছে নাকি-এ বয়সে। 

গোসল করে বাড়ি ফিরে উঠানে এসে মাটিতে পুতা বাঁশ আর ঘরের দাওয়ার লগে টানানো রশির সাথে ভিজা কাপড়টা রৌদে দিয়ে দুপুরের খানা খেতে বসল। খাবার শেষে করে মনু চকিতে শোয়া মাত্রই চাঁনমিয়া ডাক দিয়ে মনুর সাথে আলাপ করল আছমত আলীর অভিমত। আছমত আলী ময়নারে সাধি করতে চায়। মনু যা বলল-
‘চাচা আছমত আলী মোগো ময়নারে সাধি হরতে চায় ভাল কথা, তবে খারাপ অয়না না তাও ঠিক, কিন্তু ময়না কইব কি ’?
‘বুড়ো পাত্রের লগে ভাই মোরে সাধি দিছে’।
চাঁনমিয়া বলে, ‘মনু বুড়ো পাত্র হইলেও খাওনে-পড়নে কোন ঠেক নাই’।
চাঁনমিয়া আরো বলে, মনু যেন আলাপ করে দেখে আছমত আলী ময়নার পছন্দ কিনা’? তের বছর বয়সী কোন মেয়ে বেয়াল্লিশ বছরের পাত্র পছন্দ করবে? মনু এক কথায় উত্তর দিয়ে চাঁনমিয়ারে বলে দিলো,     ‘না হ্যাইয়্যা হইতে পারে না’।
চাঁনমিয়া পরের দিন সাঁঝ সকালে আছমত আলীরে জানিয়ে দিলো ময়নার সাথে আছমত আলীর সম্বন্ধ হবে না। আছমত আলী বলে, ‘মুই তোমার ভাতিজিরে চাই, মুই ছাড়া কেডা সাধি করবে হ্যাইডা দেখমু’।

আছমত আলীর কথায় ভয় পেয়ে মনু ও চাঁনমিয়া রাজি হওয়ার মনস্তাব করল বটে-তারপওর মনু আপত্তি করল বিয়ের খরচ পাবে কোথায় ? আছমত আলী বলে দিলো পাঁচ হাজার টাকা সাধির খরচ দিবে, ফেরৎ দিতে হবে না। সর্বশেষে রাজি না হয়ে উপায় কি ? দিন তারিখ ধার্য্য করা হয়ে গেল মাসের শুক্রবার। আছমত আলী অগ্রিম টাকা মাসিক মায়েন্দারের নিকট পাঠিয়ে দিলো। হরদমে সম্বন্ধ হয়ে গেলো। ময়না একদম রাজি না-প্রকাশ করা অসম্ভব ছিল। বাপ-মা মরা মেয়ে ভাইয়ের সংসারে বড় হইছে। ভাই যা করল মনের ব্যাথা বুকের মধ্যে চেপে আধা বুড়ো স্বামী- আছমত আলীর ঘরে চলে গেলো। নতুন আশা নিয়ে সাংসারিক জীবন আবার শুরু করল আছমত আলী। ময়না সর্বশেষে নিজেকে আছমত আলী বুড়ো জননীর সাথে খাপ খেয়ে আরাম্ভ করল সংসার। আছমত আলীর অনেক সুখ, পেয়ারা গাছ তলায় ঘুমানো বউ তিনটার চেয়ে ময়না আলাদা। সুন্দরী বটে-তবুও মনের মধ্যে একটি ভয় সার্বক্ষনিক তাড়া করছে। ময়নাও যদি তাকে ছেড়ে পেয়ারা গাছ তলায় সবুজ ঘাস বনে ঘু ঘু পাখি ডাকা গাছের নিচে চির শয্যায় চলে যায়। আছমত আলী ময়নার গোল গালের ছোট কালো তিলাটার পানে রোজ কয়বার তাকিয়ে থাকে ? হিসাবের কমতি আছে। ময়না একদিন আছমতের একধ্যানে চেয়ে থাকা দেখে বলে,
‘অমন হইর‌্যা হমস্ত দিন কি দ্যাহেন ’?
আছমত বলে, ‘তোরে ময়না তোরে দ্যাহি’।

ময়না শরম পেয়ে পাতলা পা দিয়ে শ্বাশুড়ির পাশে বসে এক খিলকি পান বানিয়ে বাঁশের চুংকির মধ্যে দিয়ে লোহার বর্মা দ্বারা ছেঁচে শ্বাশুড়ির হাতে দিলো। আর নিজে এক খিলকি পানের সাথে কমলা লেবুর এক টুকরা ছোলা দিয়ে চিবিয়ে মুখটা লাল টুকটুকে করে ফেলল। ঈষৎ পরে আছমত আলী উঠান থেকে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে ময়নার লাল টুকটুকে মুখখানা দেখে পাখির সাথে তুলনা  করে বলে, ‘ও ময়না পান খাইছ নাহি’?
‘হ খাইলাম’।

এদিকে মনু বড় অসহায় হয়ে গেলো। টাকা পয়সা না আদরের কলিজার টুকরা ছোট বোন ঘরে নাই, চলে গেছে পরের বাড়ি। কি যে কষ্ট মাঝে-মধ্যে নিজের ভাত-ব্যানুন রান্না করে খেতে হয়। ঝামেলা বিবি মাঝে মাঝে পাক করে দেয়। তারপরও একটু স্বস্তি মনুর মনে উপস্থিত নাই। একলা ঘরে কার পরান মানে ? ঘরে আগমন করলেই শূন্য শূন্য মনে হয়। সারাদিন মাঠে গরু-মহিষ রেখে সন্ধ্যাবেলা একা ঘরে প্রান শূন্য বসবাস করতে হয়।

রেনু প্রায় প্রায় গঙ্গামতির রাখাল পাড়ায় আসে বটে- কিন্তু মনুর সাথে দেখা হয় না। রেনু ঐদিন মনুর প্রতি নিজেকে দূর্বল করে ফেলছে-যেদিন মাছ ধরতে গিয়ে পায়ের গোড়ালিতে জখম হয়ে কাঁদা মাটিতে মুর্ছিত হয়ে পরেছিল। মনু কাঁধে করে মুর্ছিত অবস্থায় বাড়িতে এনেছিল। যেই রেনু একটি মুহূর্ত মনুরে বিশ্রাম দিতে নারাজ ছিল-সেই রেনু এখন মনুর প্রতি দূর্বল হয়েছে। কিন্তু প্রকাশ করার মতো সময় আজও আসেনি- কবে আসবে সেই প্রতিক্ষা। মনুর এদিকের খবর রাখে না। রেনুর প্রতি আকৃষ্ট হবার মতো মানসিকতা ওর জন্ম হয় নাই। হয়েছে রাছেলের বোন শিলার প্রতি অল্প অল্প, তা কেউ জানে না-এমনকি শিলাও। আবার মনে মনে ভাবে রাছেল বজ্জাত ওর বোন বজ্জাত না হয়ে পারে না। তবে এখন পর্যন্ত শিলা ভালই মনে হয়।

একদিন দুপুর বেলা এক কলসি পানি আনতে রেনু গো বাড়ির সম্মুখে নলকূপে যায় মনু। রেনু তখন নলকূপে গোসল করে দেখে মনু তফাতে দাঁড়িয়ে মাটির কলসি উপুর করে উপর বসে গান গাইতে আছে উচ্চস্বরে না গুন গুন করে। কোন গান তা কে জানে ? রেনুর ধীরে ধীরে স্নান করার জন্য বিরক্ত হয়ে যায়। রেনুর ধীর গতিতে স্নান করার একটা কারন আছে- স্নান করতে যত বেশী সময় ব্যয় হবে মনুরে দেখা যাবে। রেনু কেন মনুরে এত বেশী দেখতে চায় ? রেনু আর মনুর মধ্যে আসমান-জমিনের ব্যবধান। রেনুর নিজের অজানা তা তো আর হতে পারে না ? আসমান-জমিনের ব্যবধান পাত্তা দিলে আর যাইহোক প্রনয় চলতে পারে না।

মনুর উপুর করা জল শূন্য মাটির কলসিতে ঘন্টা খানিক  বসে অধৈর্য হয়ে নারিকেল পাতার হাউলির মধ্যে কূপের দিকে অগ্রসর হতে আরাম্ভ করল। রেনু ভিজা পাজামা-কামিজ পাল্টে শুকনো পোশাক শরীরে জড়াতে পারে নাই। রেনু তাড়াহুড়া পাল্টাতে গিয়ে প্যাঁচিয়ে পড়ল হায় হায় মনুন্যা যদি না থামে ? মনুর আগমনের গতি দেখে রেনু বলে, ‘মনুন্যা এহানে আইস না, ঐহানে খাড়া’। মনুর হাটার গতি কমিয়ে বড় বাদাম গাছটার ওপাশে পশ্চিম মুুখি হয়ে দাঁড়াল। রেনু বলে, ‘এহন নে পানি’।  
মনু কূপের কাছাকাছি এগুতেই রেনু বলে, ‘রাগ হইছে মনুন্যা’?  
‘না’
রেনু বলে, ‘মুই তোরে দ্যাহার লইগ্যা দেরি হরছি’।
মনু বলে, ‘মোর কি দ্যাখলি, রূপ বাড়ছে না কমছে’?

রেনু ‘বাড়ছে’ বলে নিজের কথায় নিজে লজ্জা অনুভব করে ভিজা পাজামা-কামিজ হাউলি বাঁশের সাথে রেখে দৌড়ে ঘরে চলে গেল। মনু কলসে জল ভরে কাঁধের ছিড়া গামছাটা মাথায় পাগড়ি বেঁধে কলসি নিয়ে বাড়ি আসল। মনু জল্পনা-কল্পনা করল শত- তবুও রেনুর ভাব মতি-গতি কিছুই আয়ত্বে আনতে পারল না। কচি মনের কচি মনু। রেনুর মত অত ভাব-সাফ বুঝার জ্ঞান আয়ত্ব করার সময় কোথায়? অভাব, দুঃখ-কষ্টের সাথে যুদ্ধ করতে করতে দিনের সূর্য কিংবা ঘোর তমস্যা দূর হয়ে যায়। এতদিন মনু পরের গরু-মহিষ রাখ্খালি রেখে হাসেম জোমাদ্দারের রবিশষ্যে ক্ষেতে, বর্ষাকালে হালুটির কাজ করে একটা পয়সাও জমা করতে পারে নাই। বছর খানেক আগে মাত্র দেড় হাজার টাকা জমা করেছিল। তাও আবার হাতছাড়া হয়ে গেছে রাখাল পাড়ার মাইল দু’ই তফাতে চাপলীর হাটের দাওয়াখানার মালিক সোহরাফ মল্লিকের ড্রয়ারে। গত বছর মনুর কঠিন ও জটিল পেটে ব্যাথা উঠেছিল। চাঁনমিয়া মনুরে নিয়ে সোহরাফ মল্লিকের দাওয়াখানায় গেলে সোহরাফ মল্লিক পরীক্ষ-নিরীক্ষা করে দেখল মনুর পেটের পাকস্থালীর একটু উপরে নাভি বরাবর গ্যাষ্টিকে ঘাঁ হয়ে আলসারে পরিনত হয়েছে। খালি পেটে থাকতে থাকতে এ অবস্থা হয়েছে সোহরাফ মল্লিক বলে দিলো। তখন মনুর কষ্টের অর্জিত জমা রাখা টাকা হাতছাড়া হয়েছে।

বাপ-মা বেঁচে থাকলে স্কুলে যাওয়া হতো মনুর ধারণা। সত্য কিনা মিথ্যা কে জানে ? কারণ রাখাল পাড়ার একটি পোলাপাইনও স্কুল মুখি হতে পারেনি। স্কুলে পাঠাবার মতো মন ছিল চাঁনমিয়ার নিজের পোলা  সাজু ও মজুরে- কিন্তু পারে নাই। অভাবের সাথে পাল্লা দিয়ে। শুধু নাম-দাম লেখার মতো লেখা-পড়া শিখছে, তাও আবার স্কুলে না স্কুল বহু দূরে। রাখাল পাড়ার পাশের গ্রামের গিয়াস উদ্দিনের কাছে।

মনু একদিন গিয়াস উদ্দিনের বাপের কাছে যায় চাচা চাঁনমিয়ার জন্য অল্প তামাক কর্জ আনতে। সেসময় গিয়াস উদ্দিন পনের জন ছাত্র-ছাত্রী একসাথে পড়াচ্ছে। একসাথে সকলে উচ্চ কন্ঠে নামতা পড়তেছে। মনুর কাছে খুব ভালই লাগল কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল। আফসোস করে বলল,‘হায়রে লেহা-পড়া ! নিজের নামডা লেহাও হেকতে পারলাম না’।
ঈশ্বরের প্রতি অভিমান করে বলে, ‘ও খোদা তোমার কি মোগো লইগ্যা এহনও দরদ অয়না ? তুমি কি ঐ মহাজন পাড়ায় থাকবা মোগো গ্রামে মোডেও আবা না ? না তোমার আওয়া লাগবে না, ঐ পাড়ায়  একটা শক্ত ঘর বানাইয়া থাহো’।
পাঁচদিন গত হয়ে গেলো। মনু গঙ্গামতি রাখাল বন্ধুদের সাথে গরু-মহিষ রাখতে চলে গেল। গত বছর মারা যাওয়া  ওসমানের বাপ হায়দার আলী নিরিবিলি উঁচু বালুর ধূমের উপর প্রকান্ড করমজা গাছটার নিচে বসে কি যেন ভাবতেছে। মনু ধীরে ধীরে এসে পাশে বসে জিজ্ঞাসা করল, হায়দার আলী কি ভাবছে ? হায়দার আলী সোজা বলে দিলো কিছুই ভাবে না। মনু এবার আপত্তিকর নরম কন্ঠে ছোট্ট করে রেনুর আবেগের কথাটার মানে জানতে চাইল। হায়দার আলী প্যাঁচাপ্যাঁচি না করে সহজে বলে দিলো রেনু মনুর সাথে পিরিত করতে চায়। মনু কথাটা শুনে কিছুক্ষন কচি বয়সের মাথাটা নিচু করে চুপ-চাপ বসে কি যানো ভাবছে- তা কে জানে?  আবার উঠে গনি, রাছেল ও নতুন বন্ধু সেকান্দার যেখানে সেখানে চলে গেল।

সেকান্দার এবছর নতুন গরু-মহিষ রাখতে ওদের সাথে যোগ হয়েছে বটে-তবে ওদের মতো রাখ্খালি না। রাখাল পাড়ার পশ্চিম পাশের গ্রামের মাইনউদ্দিনের গরু রাখতে। মাসে সাতশত টাকা মাহিনায় কাজে থাকছে। সেকান্দার বয়সে সবার চেয়ে ছোট বটে- তবে স্বাস্থ্যটা বেশ মোটা তাজা, কালো মনে হয় শরীরে সরিষার তৈল মেখে থাকে। সেরকমের তেল তেলে দেখায়। সেকান্দারের বাড়ি অন্য এলাকায়। সেকান্দার ছেলে হিসেবে খারাপ না সকলের সাথে মিলেমিশে থাকতে পারবে। ছোট বেলা থেকে অন্যের সাথে মাসিক মাহিনায় কাজ করে।

আজ সূর্যটা পশ্চিম আসমানে হেলে পরার আগে মনু গঙ্গামতির চর থেকে রাখায় পাড়ায় ফিরে আসল। ছোট্ট কুটিরের মেঝেতে গেওয়া কচার পাতা মাচনে শুয়ে পরল, শরীরটা ক্লান্ত মনে হয়। কিছুক্ষন বিশ্রাম নিয়ে ঝামেলা বিবি রান্না করা ভাত-ব্যানুন ঘরের মেঝে ফুটা ওগলায় বসে দেখল জলের কলসিটা খালি। মনু দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে মাটির কলসি হাতে নিয়ে হাসেম জোমাদ্দারের নলকূপের সন্নিবেষ্টিত হবার পূর্বে তফাত থেকে রেনু দেখল মনু ওদের কূপে আসতেছে। মুন কূপের হাউলির মধে ডোকার পরপর রেনু ঘরের জল খাবার জগটা নিয়ে আসল।
মনুরে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘ক্যমন আছ মনু’?
মনু বলে, ‘হ ভাল আছি’। 
রেনু বলে, ‘তোর লগে মোর কথা আছে’।
মনু বলে,‘কি কবি ক ’।
রেনু বলে,‘এহন কইতে পারমু না’।
মনু বলে, ‘না পারলে ঘরে যাইয়্যা ঘুমা, খালি খালি ফ্যার ফ্যার করিস না’।
মনু মাটির কলসিটা এক ধাক্কায় হাটু পর্যন্ত পরের ধাক্কায় মাথার ছিড়া গামছাটার মোড়ানো পাগরিতে বসিয়ে চলে আসল রাখাল পাড়ায়।  রেনু মুখ মলিন করে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে ফিস ফিস করে বলল,
‘হায়রে মনুন্যা কত না জিৎ দ্যাহাবি এহন, মুইও দ্যাহুম তোর জিৎ কত? তোরে আটকাইতে না পারলে মুই জোমাদ্দার বাড়ির মাইয়্যা না’।
রেনু ঘরের গিয়ে চকির উপরে উপুড় হয়ে থাকল কিছুক্ষন।

মনু গঙ্গামতির চরে গিয়ে সকলে মিলে গল্প-কেচ্ছা বলছে, যে যা পারে। প্রকান্ড বিস্তীর্ন মৌফল গাছের নিচে নিত্য দিনের মতো আজও বসে। গঙ্গামতির চরে টিলার মতো উঁচু বালুর ধূমে লেন্দি বরই গাছে বিস্তর বরই ধরেছে। লেন্দি বরই গাছগুলো গ্রাম-গঞ্জের কুল গাছের মতো অবিকল উঁচু না। তবে ডাল-পাতা-কাটার কোন ব্যবধান নাই। ব্যবধানটা শুধু গ্রাম-গঞ্জের বরই খেতে হলে গাছে অথবা লম্বা লাঠি দিয়ে পারতে হয় আর লেন্দি বরই বালুর উপরে দাঁড়িয়ে খাওয়া যায়। লেন্দি বরই গাছ বেশ উঁচু হলে হাত পাঁচেকের বেশী না। লেন্দি বরই আকারে খুব ছোট, কাচা খেতে স্বাদ নাই বললে ভুল হবে না। কিন্তু পাকা যে বরই গুলো রোদে উত্তপ্ত শুকনা বালুতে পরে থাকে সেগুলো বেশ মজা। সেকান্দার বলে উঠল, ‘মনু বাই লেন্দি বরই খাইতে লন’। সকলে সায় দিয়ে উঠে চলে গেল, কিন্তু বুড়ো হায়দার আলী একটুও নড়ল না। হায়দার আলীকে গাছ তলায় রেখে ওরা সকলে চলে গেলো লেন্দি বরই খাইতে। লেন্দি বরই খাওয়া এত সহজ না, গাছ তলায় প্রচুর পরিমানে কাটা। আবার সূর্যের অতিরশ্মির কারনে বালু এতটাই উত্তপ্ত যে পা রাখাই মুশকিল। বরই খেতে পারে নাই দৌড়ে গেলো স্যাঁতস্যাঁতে ভিজা বালুতে। মনু একটা বুদ্ধি সাইজ করল। সাগরের জোয়ারে ভেসে আসা অনেক অকেজো জিনিসের মধ্যে পুরানো ছিড়াবিড়া অকেজো জুতা, জুতার চটি পাওয়া যায়, ভিজা বালু আর শুকনা বালুর মাঝখানে অর্থাৎ জোয়ারের পানি যে পর্যন্ত ফুলে ওঠে।

ওরা খোঁজাখুঁজি করতে করতে অনেক দূলে চলে গেলো। কেউ পেল চামড়ার ছিড় জুতা, কেউ পেল প্লাস্টিকের চাউনী ওয়ালা ছিড়া জুতা, কেউ পেল বেল ছিড়া জুতা, কেউ পেল বেল-ছাউনী বিহীন জুতার চটি। ডান পা বাম পায়ের বিচার ওরা করবে কেন ? শুধু পায়ের তলায় দিয়ে বরই খেতে পারলেই হয়। মনু যা পেল তা চটি। তিনটি ফুটা ছাড়া কিছুই নাই। মনু অকেজো ছোট ছোট দড়ি খুঁজে বেলযুক্ত জুতার মতো বানিয়ে পায়ে দিলো। সকলে পায়ের তলায় বালুর অসহ্য তাপ রক্ষাকারী জুতা পায়ে দিয়ে বরই খেয়েছে আর পড়নের কাপড়ে টোকর বানিয়ে কিছু রাখল। ঝোপে ঝোপে লেন্দি বরই পেরে হায়দার আলীর সন্নিবেষ্টিত হলো। তিনিও কিছু খেয়েছে। ওরা নিজেদের তৈরী পাদুকা গোপনে রাখল আগামীকাল আবার লাগবে তাই।
সূর্যটা মাথার উপরে ওরা রাখাল পাড়ায় আসল দুপুরের খানা গিলতে। গহিন জঙ্গল ভেদ করে আসারকালে নাগালে শুকনা লাকড়ি জাতীয় যা পায় বাড়ি নিয়ে আসে। মনু কেওড়া গাছের মাঝাড়ি এক খন্ড কাঠ নিয়ে আসল। কাঁধে করে আনতে কষ্ট কম হয় নাই, গলা এদিক-সেদিক ঘুরাতে কষ্ট হচ্ছে। আসমানের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। কিছু সময় উঠানে বসে হাফিয়ে হাফিয়ে শ্বাস টেনে ঘরে প্রবেশ করে। সরিষা তৈলের শিশিটা হাতে নিয়ে উপপুর করে কয়েক ফোটা তৈল হাতের তালুতে ডেলে দু’হাত জোড়া করে ঘষা দিয়ে ঘাড়ে মাখল। তারপর ছিড়া কাপড়টা, যেটা জঙ্গলের গহিনে আসারকালে ছিপটি গাছের কাটায় বেজে ছিড়ে গেছে। ঝামেলা বিবি পুরান মহিলা এগারো হাত কাপড়ের পাইর থেকে সূতা তুলে সুইচ দিয়ে সেলাই করে দিয়েছে। সেই কাপড়া কাঁধে নিয়ে বেড়িবাঁধের কূয়ায় গোসলে গেলো।

মনু কূয়ার পাড়ে যাবার আগে গনি, রাছেল উপস্থিত। অনেক দিন পর আজ হট্টি হট্টি খেলবে গনি বলল। ততক্ষনে মনুর আপন চাচাতো ভাই সাজু ও মজু আসল। সাজু ও মজু বয়সে ছোট্ট হলেও হট্টি হট্টি খেলতে পাকা। পাকা হবে না কেন?  নিত্য ওরা খেলে। মনু পাঁচজনের মাথা গুনে পাঁচটা শুকনো ছল নিয়ে একটু তফাতে গেলো। ছন পাঁচটা সমান করে একটা ছনে গিটু দিলো। গিটু ছনটা সহ পাঁচটা ছন একমাথা হাতের মুঠে আর অন্য মাথা বাহির করে আসল। এক একজনে একটা করে ছন ধরল। সবার শেষে ধরতে হবে মনুর খেলার আইন অনুযায়ী। যার হাতে গিটু ছনটা যাবে তার অলিকে লড়– পরবে। সকলে পানির মধ্যে ছুটবে আর লড়– সকলকে ধরবে অথবা মাথায় হাত লাগলেই হবে। পরবর্তীতে সকলে ধরা পরলে কে লড়– হবে ? এবার আর ভাগ্য পরীক্ষা লাগবে না। আসলে খুবই সহজ যে আগে ধরা পরবে সে লড়– হবে। লড়– পরল মনুর ভাগ্যে, মনু ছনটা ছেড়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। মনুর অলিকে কে জানে ? নাকি ওরা দেখেছে?
প্রথমবার মনু, পরে মজু, তারপর সাজু, একে একে সকলে লড়– হয়ে অনেকক্ষন খেলল হট্টি হট্টি। সকলের চোখ কুকুয়া পাখির চোখের মতো টকটকে লাল হয়ে গেছে। তাতে ওদের ঝামেলা নাই। ঝামেলা সাজু মজুর। চাঁনমিয়া দেখলে সাজু-মজুর পিঠে দু’একটা গেওয়া কচা ভাঙ্গবে। ওদের একটা বুদ্ধি আছে। কাচা কচু পাতা ছিড়ে চোখ বন্ধ করে হাটু বরাবরে একুল থেকে ওকুলে নিল। জিজ্ঞাসা করলে ওরা বলবে, ‘ তাতে চোখের লাল কমে যাবে’।
সত্য না মিথ্যা তা কে জানে ?
‘তবে এটা যে দুষ্টু ছেলেদের দুষ্ট কুসংস্কার তা নিশ্চিত বলা যায়’।
সাজু মজুরে লক্ষ্য করে মনু বলে, ‘তোগো আইজ খবর আছে’।

কারন গত সপ্তাহে চাঁনমিয়া সাজু মজুরে জলে নেমে ডুবানোর জন্য পিটিয়েছে। তাতে ওদের শরীরে জ্বর উঠেছিল। পরে আবার চাঁনমিয়া চাপলীর হাট থেকে একটা জ্বরের সিরাপ এনে দিয়েছিল। সাজু মজু ডরে ঘরে গেলো না। কোথায় যেন পালিয়েছে। চাঁনমিয়া দুপুরের খানা খেয়ে কাজে গেলে বের হবে। মনু ভাত খেয়ে মঙ্গামতি চলে গেলো। চাঁনমিয়া বাড়ি ফিরে সাজু মজুরে না দেখে ঝামেলা বিবির কাছে জিজ্ঞাসা করল, ‘কৈ কি হুনছ, পোলাপাইন কৈ, দেখছি না যেন’।
ঝামেলা বিবি, ‘কৈইতে পারি না আমনে বোলান দেন’।
চাঁনমিয়া সাজু মজু বলে জোড় গলায় কয়েকটা ডাক দিলো বটে- কিন্তু কোন সারা নাই। ওরা দু’ভাই রাস্তার পাশে ঝোপের মধ্যে পালাইছে। চাঁনমিয়া দুপুরের খাবার খেয়ে কাজে যাবার আগে ঝামেলা বিবিকে উদ্দেশ্য করে বলে গেলো,
‘আইজ যদি অগো ভাত দেও, তাইলে তোরে নামাইয়্যা দিমু’।

---------------******-------------

No comments

Powered by Blogger.