গঙ্গামতির রাখাল-(পর্ব-ছয়)
গঙ্গামতির রাখাল-(পর্ব-ছয়)
বেশ কিছু দিন পরের কথা।
স্বামীর বাড়ি থেকে ময়না ভাইয়ের বাড়ি বেড়াতে এসেছে। খবরটা সবার পূর্বে যেন রেনু পেল। রেনু রাখাল পাড়ার খবরা খবর কম রাখে না। মনে হয় বাংলাদেশ বেতার সেন্টারগুলো ও বি.বি.সি’র খবর প্রচারও রেনুর কাছে হার মানবে। গঙ্গামতির রাখার পাড়ার সমস্ত খবর রেনুর কাছে পাওয়া যায়। ময়না অনেক দিন পর বেড়াতে এসেছে বাপের বাড়ি সত্য বটে- কিন্তু বাপ তো জীবিত নাই, তাই ভাইয়ের বাড়ি বললেই চলবে। বহু দিন পরে ভাইয়ের বাড়ি এসে ঝামেলা বিবির কাছে জিজ্ঞাসা করল, ‘চাচিমা ক্যামন আছেন ? ভাইয়্যা কোমনে’?
ঝামেলা বিবি বলে, ‘চরে গ্যাছে গরু-মহিষ চড়াইতে’।
Novel Cover Photo |
বেশ কিছু দিন পরের কথা।
স্বামীর বাড়ি থেকে ময়না ভাইয়ের বাড়ি বেড়াতে এসেছে। খবরটা সবার পূর্বে যেন রেনু পেল। রেনু রাখাল পাড়ার খবরা খবর কম রাখে না। মনে হয় বাংলাদেশ বেতার সেন্টারগুলো ও বি.বি.সি’র খবর প্রচারও রেনুর কাছে হার মানবে। গঙ্গামতির রাখার পাড়ার সমস্ত খবর রেনুর কাছে পাওয়া যায়। ময়না অনেক দিন পর বেড়াতে এসেছে বাপের বাড়ি সত্য বটে- কিন্তু বাপ তো জীবিত নাই, তাই ভাইয়ের বাড়ি বললেই চলবে। বহু দিন পরে ভাইয়ের বাড়ি এসে ঝামেলা বিবির কাছে জিজ্ঞাসা করল, ‘চাচিমা ক্যামন আছেন ? ভাইয়্যা কোমনে’?
ঝামেলা বিবি বলে, ‘চরে গ্যাছে গরু-মহিষ চড়াইতে’।
ময়না ভাই ছাড়া শূন্য বাড়িতে ঝামেলা বিবির সাথে অনেক আলোচনা করে। স্বামীর আছমত আলী কোন প্রকৃতির লোক, আছমত আলীর বুড়ো মায় ভাল না মন্দ ? খাওয়া-দাওয়ায় কোন কষ্ট আছে কিনা ? ময়নার সাথে যে ঝামেলা বিবি একা আলোচনা করছে তা নয়- রাখাল পাড়ার ছোট-বড় সকলে, যারা পাড়ায় ছিল জমা হয়েছে ময়নার মুখোমুখি। দেখলে মনে হবে-ময়না হয়তো কোনকালে মারা গেছে গুঞ্জন ছড়িয়েছিল আবার হঠাৎ কোথা থেকে যেন ফিরে এসেছে।
পাশাপাশি গ্রামে ময়নার পরের বাড়ি। স্বামীর বাড়ি যাওয়ার পর একবার গিয়েছিল চাঁনমিয়া ও মনু এক কেজি আড়াই প্যাঁচের জেলাপি নিয়ে। সেজন্য ময়নার অনুযোগের কমতি আছে বলে মনে হবে না। কেমন করে ভাই চাচা আর একবারও না গিয়ে থাকতে পারল ? ময়না প্রশ্ন করলে ঝামেলা বিবি বলে, ‘যাইবে ক্যামনে মা হাতে টাহা পয়সা নাই’।
ময়না বলে, ‘টাকা পয়সা না থাকলে যাওয়া না বুঝি, গাড়ি ঘোড়ার পোত নাকি’?
ঝামেলা বিবি বলে,‘ খালি হাতে কি যাওয়া যায়? কিছু নাহইলেও তোর হাউরির লইগ্যা পান-সুবারি নেওয়া লাগে’।
ময়না বলে, ‘ ও কথা রাহেন’।
ঝামেলা বিবি বলে,‘ময়না ঘরের মধ্যে কলসে চাউল আছে ভাত রান্দিস’।
ময়না ভাত আর ডাল রান্না করে। মাত্র দেড় মাসের ব্যবধানে ময়না শূন্য বাড়িতে লক্ষ্মী বিদায় নিয়ে চলে গেছে কোথায় তা কে যানে? ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলে অনুমান করা মুশকিল- ওটা মানুষ থাকার ঘর না ছাগলের ঘর। ঘরের একটি মালামালও ঠিক নাই। সব পরে আছে আউলা-ঝাউলা ভাবে। ময়না ধীরে ধীরে গুছগাছ করল। মনু চর থেকে এসে ময়নারে দেখে জলে ছল ছল চোখে ময়নারে জড়িয়ে ধরে বলে,
‘ময়না তুই আইছ বোইন আমার, এতদিন পর বাইর কথা বুঝি মনে পরছে’?
ময়না কাজল কালো চোখের জল ছেড়ে দিয়ে বলে, ‘হ আইছি’।
মনু হাতে দিয়ে ছোট বোনের চোখের অশ্র“ মুছতে মুছতে বলে,‘কান্দিস না বোইন মোর কান্দিস না’।
তারপর মনু গোসল করতে চলে গেলো। ফিরে এসে ঘরে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আনন্দ মনে কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে, গঙ্গামতির চলে গেলো অন্য রাখাদের সাথে। বিকাল বেলা ময়না ঝামেলা বিবির কাছে পোঁকা ভরা মাথার উকুন বাছতে বসল। দেড় মাসে চুলের পোকা বাছা হয় নাই। বুড়ো শ্বশুড়ি চোখে যা দেখে তা দিয়ে চুলের পোঁকা বাছা সহজ না। ঝামেলা বিবি ময়নার মাথার উকুন দেখে বে-দিক হয়ে গেলো। মনে হয় ময়নার মাথায় যত চুল তত উকুন। ঝামেলা বিবি বলে,
‘যাবারকালে মোগো উহুন আনার কাহইটা লইয়্যা যাইস’।
যেটাকে হাড়ের চিরুনী বলা হয়। চাঁনমিয়া চাপলী হাটের ভাসমান দোকান থেকে এক টাকায় কিনে আনছিল গত বছর। কিছুক্ষণ পরে রেনু রাখাল পাড়ায় আগমন করল।
ময়নারে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘ও ময়না আইলি কহন’?
ময়না তা সঠিকভাবে উত্তর না দিয়ে বলে,‘তুমি আছ ক্যামন রেনু আপা’?
রেনু বলে, ‘হ ভালই আছি, তুই ’?
ময়না বলে, ‘ভাল না থ্যাইকা পারি ক্যামনে’?
হঠাৎ কোথা থেকে যেন চাঁনমিয়া আসল। ঝামেলা বিবি চলে গেলো। ময়না ও রেনু কত প্যাঁচাল পারল তা কে জানে ? এক পর্যায়ে রেনু বলে, ‘তোর ভাইরে অহন একটা বিয়া করা’।
ময়না বলে,‘মুই কি বিয়া করাইতে পারি’?
রেনু বলে, ‘তুই তোর ভাইরে বিয়ে করতে অনুরোধ করবি’।
ময়না বলে, ‘হ্যাইয়্যা না হয় করলাম, কিন্তু বাই তো ওকথা হোনতেই পারে না’।
রেনু বলে,‘আহা মোসকিল তো’।
ময়না বলে,‘মোসকিল ক্যান ভাইর ধারনা হ্যারে মাইয়্যা দেবে কেডা’?
কথা থাকে, যে ঘরে মাঝে মধ্যে চালের অভাবে চুলায় বিড়াল ঘুমায়, ভাতের হাড়িতে মাকরশায় জালবুনে, পিঁপড়া গুলো বাড়ি ছেড়ে পাড়ি জমায় অন্যত্র সে বাড়িতে মেয়ে বিয়ে দেবে কে ?
রেনু প্যাঁচাল না বাড়িয়ে সহজে বলে, মোরে তোর ভাই বৌ হিসেবে পছন্দ করবে’? ময়না কথাটা শুনে বোকা হয়ে গেলো। যেন বামন হয়ে চাঁদের দিকে হাত বাড়ানোর মতো মনে হলো ময়নার। একটু সময় নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ময়না বলে,‘রেনু আপা তুই এহন যা, তোর বাহে হোনলে মোর বাইরে আর কামে রাখবে না। শেষে না খাইয়্যা মরবে মোর বাই’। সন্ধ্যা প্রায় ঘনিয়ে আসল। প্রতৃতি থেকে দিন বিদায় নিবে নিবে ভাব। আসমান থেকে সূর্য একটু আগে ক্ষনিকের জন্য বিদায় নিয়ে চলে গেছে। রেনু চলে গেলো রাখাল পাড়া থেকে।
মনু ও অন্যরা সন্ধ্যার পরপর রাখাল পাড়ায় আসল। জ্যোস্নালোকিত রাত্র ফকফকে জোনাক। কারো চোখে ঘুম আসে না। রাখাল পাড়ার মাঝ উঠানে রাছেলের বাপের ঘরের সামনে ছেলে-মেয়ে, যুয়ান-বুড়ো সকলে মিলে বসল। সকলের অনুরোধে শানু ঘরামী একটা গল্প বলতে রাজি না হয়ে পারল না। শুনতে গল্পের মতো আসলে কাহিনী বাস্তবিক সত্য। বছর পঁচিশে পূর্বে শান্ত আসমানে গঙ্গামতি ও আশেপাশে পাঁচ-সাত গ্রামের জেলেরা বঙ্গোপসাগের বুকে মাছ ধরতে গিয়েছিল। রাত বারোটার সময় হঠাৎ পূর্ব আসমান কালো হয়ে মুহূর্তের মধ্যে ঘূর্ণিঝড়ে হাজার হাজার জেলেদের প্রান নামের পাখিটা কেঁড়ে নিয়ে প্রান শূন্য দেহটা সমুদ্রের হাজারো প্রজাতির মাছ ও কুমিড়কে খেতে দিয়েছিল। অনেক জেলে পূর্বের ঝড়ের বাতাসে নৌকা ও নৌকাট্রলার সহ চলে গেছে ভারতে অনেকের ধারণা-কতটা সত্য তা কে জানে? বন্যার দু’এক দিন পরে পটকা মাছে খাওয়া পঁচা গলা লাশগুলো সাগরের কিনারায় ভেসে আসতে আরাম্ভ করছিল। বহু জেলে নিখোঁজ হয়েছিল। আজও তাদের সন্ধান মেলেনি। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শত শত ছেলে-মেয়ে, পুরুষ-মহিলার কান্নার আহাজারির শব্দে সবুজ গাছের পাতাগুলো ঝড়ে পরছিল। প্রতিক্ষা শুধু আপন জনের লাশ পাওয়ার। সকলেরই জানা ছিল জীবিত পাওয়া যাবে না। মরা লাশটা একবার দু’নয়নে দেখে বাড়ির পাশে মাটির তলে শুয়ে দেওয়ার আশা। প্রতিদিন সকালে একটা আগর বাতি, মোম বাতি জ্বালিয়ে শ্রদ্ধা করবে। কেউ আপনজনের লাশ পেয়েছিল কেউ লাশ না পাবার বেদনা নিয়ে বাড়ি ফিরে আসছিল। বিধাতা আপজনের মরা পঁচা লাশটা দেখার মতো ভাগ্য অনেককে দেয় নাই। শানু ঘরামী সেই পঁচিশ বছরের পূর্বের ভয়াবহ বন্যার সত্য কাহিনী গল্পের মতো করে বলল। মনু ওখানে গল্প শুনতে গিয়ে ফাঁকে ফাঁকে শিলার চেহারাটা দেখেছে। মনুর সাথে শিলারে বেমানান না, তা কেহ অনুভব করে নাই। ছোট বড় কেচ্ছা কাহিনী কম বেশি সকলে বলেছে। রাত্র অনেক হলো, কেহ কেহ ঘুমের নেশার মুখটা হাঁ করে হাউসি দিতে আরাম্ভ করল। ধীরে ধীরে একজন দু’জন উঠতে উঠতে বৈঠক লোক শূন্য হয়ে গেলো। গল্পের আসর ভেঙ্গে গেলো। রাছেলের বাপে তামাক আর দিয়াশলাইর বাডাটা নিয়ে আধাপেডি গিলে ঘুমিয়ে পড়ল। মনু ঘরে গিয়ে ময়নারে উঠিয়ে ভাত খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। কখন ঘুমিয়ে পড়ল কে জানে ?
সাঁঝের বেলা ঘুম থেকে উঠে সকলে একাত্রিত হয়ে গঙ্গামতির চরে চলে গেলো। মনু বাড়ি হতে যাবার সময় হাতে করে একটা দা নিয়ে গেলো। গত কাল জঙ্গলে গরু-মহিষ তাড়াতে গিয়ে জঙ্গলের গহিনে এক জায়গায় অনেক গুলো ‘কেওয়াফল’ দেখেছিল। সেই ‘কেওয়াফল’ কথা মনে করে দা নিয়ে গেল। রাছেল জিজ্ঞাসা করল, ‘মনুন্যা দা আনছো ক্যান’?
মনু বলে, ‘কাম আছে’।
ময়না বলে, ‘টাকা পয়সা না থাকলে যাওয়া না বুঝি, গাড়ি ঘোড়ার পোত নাকি’?
ঝামেলা বিবি বলে,‘ খালি হাতে কি যাওয়া যায়? কিছু নাহইলেও তোর হাউরির লইগ্যা পান-সুবারি নেওয়া লাগে’।
ময়না বলে, ‘ ও কথা রাহেন’।
ঝামেলা বিবি বলে,‘ময়না ঘরের মধ্যে কলসে চাউল আছে ভাত রান্দিস’।
ময়না ভাত আর ডাল রান্না করে। মাত্র দেড় মাসের ব্যবধানে ময়না শূন্য বাড়িতে লক্ষ্মী বিদায় নিয়ে চলে গেছে কোথায় তা কে যানে? ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলে অনুমান করা মুশকিল- ওটা মানুষ থাকার ঘর না ছাগলের ঘর। ঘরের একটি মালামালও ঠিক নাই। সব পরে আছে আউলা-ঝাউলা ভাবে। ময়না ধীরে ধীরে গুছগাছ করল। মনু চর থেকে এসে ময়নারে দেখে জলে ছল ছল চোখে ময়নারে জড়িয়ে ধরে বলে,
‘ময়না তুই আইছ বোইন আমার, এতদিন পর বাইর কথা বুঝি মনে পরছে’?
ময়না কাজল কালো চোখের জল ছেড়ে দিয়ে বলে, ‘হ আইছি’।
মনু হাতে দিয়ে ছোট বোনের চোখের অশ্র“ মুছতে মুছতে বলে,‘কান্দিস না বোইন মোর কান্দিস না’।
তারপর মনু গোসল করতে চলে গেলো। ফিরে এসে ঘরে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আনন্দ মনে কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে, গঙ্গামতির চলে গেলো অন্য রাখাদের সাথে। বিকাল বেলা ময়না ঝামেলা বিবির কাছে পোঁকা ভরা মাথার উকুন বাছতে বসল। দেড় মাসে চুলের পোকা বাছা হয় নাই। বুড়ো শ্বশুড়ি চোখে যা দেখে তা দিয়ে চুলের পোঁকা বাছা সহজ না। ঝামেলা বিবি ময়নার মাথার উকুন দেখে বে-দিক হয়ে গেলো। মনে হয় ময়নার মাথায় যত চুল তত উকুন। ঝামেলা বিবি বলে,
‘যাবারকালে মোগো উহুন আনার কাহইটা লইয়্যা যাইস’।
যেটাকে হাড়ের চিরুনী বলা হয়। চাঁনমিয়া চাপলী হাটের ভাসমান দোকান থেকে এক টাকায় কিনে আনছিল গত বছর। কিছুক্ষণ পরে রেনু রাখাল পাড়ায় আগমন করল।
ময়নারে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘ও ময়না আইলি কহন’?
ময়না তা সঠিকভাবে উত্তর না দিয়ে বলে,‘তুমি আছ ক্যামন রেনু আপা’?
রেনু বলে, ‘হ ভালই আছি, তুই ’?
ময়না বলে, ‘ভাল না থ্যাইকা পারি ক্যামনে’?
হঠাৎ কোথা থেকে যেন চাঁনমিয়া আসল। ঝামেলা বিবি চলে গেলো। ময়না ও রেনু কত প্যাঁচাল পারল তা কে জানে ? এক পর্যায়ে রেনু বলে, ‘তোর ভাইরে অহন একটা বিয়া করা’।
ময়না বলে,‘মুই কি বিয়া করাইতে পারি’?
রেনু বলে, ‘তুই তোর ভাইরে বিয়ে করতে অনুরোধ করবি’।
ময়না বলে, ‘হ্যাইয়্যা না হয় করলাম, কিন্তু বাই তো ওকথা হোনতেই পারে না’।
রেনু বলে,‘আহা মোসকিল তো’।
ময়না বলে,‘মোসকিল ক্যান ভাইর ধারনা হ্যারে মাইয়্যা দেবে কেডা’?
কথা থাকে, যে ঘরে মাঝে মধ্যে চালের অভাবে চুলায় বিড়াল ঘুমায়, ভাতের হাড়িতে মাকরশায় জালবুনে, পিঁপড়া গুলো বাড়ি ছেড়ে পাড়ি জমায় অন্যত্র সে বাড়িতে মেয়ে বিয়ে দেবে কে ?
রেনু প্যাঁচাল না বাড়িয়ে সহজে বলে, মোরে তোর ভাই বৌ হিসেবে পছন্দ করবে’? ময়না কথাটা শুনে বোকা হয়ে গেলো। যেন বামন হয়ে চাঁদের দিকে হাত বাড়ানোর মতো মনে হলো ময়নার। একটু সময় নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ময়না বলে,‘রেনু আপা তুই এহন যা, তোর বাহে হোনলে মোর বাইরে আর কামে রাখবে না। শেষে না খাইয়্যা মরবে মোর বাই’। সন্ধ্যা প্রায় ঘনিয়ে আসল। প্রতৃতি থেকে দিন বিদায় নিবে নিবে ভাব। আসমান থেকে সূর্য একটু আগে ক্ষনিকের জন্য বিদায় নিয়ে চলে গেছে। রেনু চলে গেলো রাখাল পাড়া থেকে।
মনু ও অন্যরা সন্ধ্যার পরপর রাখাল পাড়ায় আসল। জ্যোস্নালোকিত রাত্র ফকফকে জোনাক। কারো চোখে ঘুম আসে না। রাখাল পাড়ার মাঝ উঠানে রাছেলের বাপের ঘরের সামনে ছেলে-মেয়ে, যুয়ান-বুড়ো সকলে মিলে বসল। সকলের অনুরোধে শানু ঘরামী একটা গল্প বলতে রাজি না হয়ে পারল না। শুনতে গল্পের মতো আসলে কাহিনী বাস্তবিক সত্য। বছর পঁচিশে পূর্বে শান্ত আসমানে গঙ্গামতি ও আশেপাশে পাঁচ-সাত গ্রামের জেলেরা বঙ্গোপসাগের বুকে মাছ ধরতে গিয়েছিল। রাত বারোটার সময় হঠাৎ পূর্ব আসমান কালো হয়ে মুহূর্তের মধ্যে ঘূর্ণিঝড়ে হাজার হাজার জেলেদের প্রান নামের পাখিটা কেঁড়ে নিয়ে প্রান শূন্য দেহটা সমুদ্রের হাজারো প্রজাতির মাছ ও কুমিড়কে খেতে দিয়েছিল। অনেক জেলে পূর্বের ঝড়ের বাতাসে নৌকা ও নৌকাট্রলার সহ চলে গেছে ভারতে অনেকের ধারণা-কতটা সত্য তা কে জানে? বন্যার দু’এক দিন পরে পটকা মাছে খাওয়া পঁচা গলা লাশগুলো সাগরের কিনারায় ভেসে আসতে আরাম্ভ করছিল। বহু জেলে নিখোঁজ হয়েছিল। আজও তাদের সন্ধান মেলেনি। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শত শত ছেলে-মেয়ে, পুরুষ-মহিলার কান্নার আহাজারির শব্দে সবুজ গাছের পাতাগুলো ঝড়ে পরছিল। প্রতিক্ষা শুধু আপন জনের লাশ পাওয়ার। সকলেরই জানা ছিল জীবিত পাওয়া যাবে না। মরা লাশটা একবার দু’নয়নে দেখে বাড়ির পাশে মাটির তলে শুয়ে দেওয়ার আশা। প্রতিদিন সকালে একটা আগর বাতি, মোম বাতি জ্বালিয়ে শ্রদ্ধা করবে। কেউ আপনজনের লাশ পেয়েছিল কেউ লাশ না পাবার বেদনা নিয়ে বাড়ি ফিরে আসছিল। বিধাতা আপজনের মরা পঁচা লাশটা দেখার মতো ভাগ্য অনেককে দেয় নাই। শানু ঘরামী সেই পঁচিশ বছরের পূর্বের ভয়াবহ বন্যার সত্য কাহিনী গল্পের মতো করে বলল। মনু ওখানে গল্প শুনতে গিয়ে ফাঁকে ফাঁকে শিলার চেহারাটা দেখেছে। মনুর সাথে শিলারে বেমানান না, তা কেহ অনুভব করে নাই। ছোট বড় কেচ্ছা কাহিনী কম বেশি সকলে বলেছে। রাত্র অনেক হলো, কেহ কেহ ঘুমের নেশার মুখটা হাঁ করে হাউসি দিতে আরাম্ভ করল। ধীরে ধীরে একজন দু’জন উঠতে উঠতে বৈঠক লোক শূন্য হয়ে গেলো। গল্পের আসর ভেঙ্গে গেলো। রাছেলের বাপে তামাক আর দিয়াশলাইর বাডাটা নিয়ে আধাপেডি গিলে ঘুমিয়ে পড়ল। মনু ঘরে গিয়ে ময়নারে উঠিয়ে ভাত খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। কখন ঘুমিয়ে পড়ল কে জানে ?
সাঁঝের বেলা ঘুম থেকে উঠে সকলে একাত্রিত হয়ে গঙ্গামতির চরে চলে গেলো। মনু বাড়ি হতে যাবার সময় হাতে করে একটা দা নিয়ে গেলো। গত কাল জঙ্গলে গরু-মহিষ তাড়াতে গিয়ে জঙ্গলের গহিনে এক জায়গায় অনেক গুলো ‘কেওয়াফল’ দেখেছিল। সেই ‘কেওয়াফল’ কথা মনে করে দা নিয়ে গেল। রাছেল জিজ্ঞাসা করল, ‘মনুন্যা দা আনছো ক্যান’?
মনু বলে, ‘কাম আছে’।
গরু-মহিষ জঙ্গলে ছেড়ে সবাইকে নিয়ে জঙ্গলে ‘কেওয়াফল’ গিলতে গেল। ‘কেওয়াফল’ গাছ দেখতে অবিকল আনারস পাতার মতো লম্বা কাটাযুক্ত। ফলটা দেখলে একদম আনারসের মতো কিন্তু ভিতরে কাঠালের কোয়ার মতো। তবে অতো সুস্বাদু না। কেওয়া গাছের পাতার বেশ চাহিদা আছে-ফলের তুলনায়। কেওয়া পাতা দিয়ে ওগলা বুনলে বেশ মজবুত হয়। এক শ্রেণীর পেশাজীবি মহিলা-পুরুষ কেওয়া পাতা কেটে কাটা ফেলে ওগলা বুনে হাটে বিক্রি করে। “লাভ আর কষ্ট যমজ ভাই”। কারন জঙ্গলের গহিনে খোঁজাখুঁজি করে পাতা কেটে লতাপাতার মধ্য থেকে বের করে বাড়িতে এনে কাটা ফয়লা করতে ঝামেলার কমতি নাই।
মনু বন্ধুদের নিয়ে ‘কেওয়াফল’ খেয়েছে কম না অনেক। সেকান্দার বোঁকার মতো কাজ করল। ‘কেওয়াফল’ খেয়েছে আনারসের মতো। কিছুক্ষন পরে গলা ও মুখের মধ্যে চুলকানি শুরু হলো। সেকান্দার বলে, ‘মুই আর খামু না একদিনও, খাউজা খাউজি ভাল লাগে না’।
গিলতে গিলতে বেলা দুপুর হয়ে গেল। হাতে করে দু’চারটা ফল সকলেই বাড়িতে আনল। ময়নার ‘কেওয়াফল’ ভারি পছন্দ, মজা করে গিলল।
বিকাল তিনটার মতো রাখাল পাড়ায় পুরুষ বলতে কেউ আছে বলে মনে হচ্ছে না। রেনু ময়নার সাথে আলাপ করতে ভুল করল না। রেনু ময়নার সাথে মনের ব্যাথা, মনের কথা, পিরিতের আবেগ ছাড়া আর কি আলাপ করবে ? ময়নার রেনুরে পছন্দ হয় কম না, কিন্তু ভাবতেছে আসমান জমিনের ব্যবধান নিয়ে। ময়না সহজ বাক্যে বলে দিলো, ‘মুই কিছুই জানি না, তোমাগো ব্যাপার’।
ছোট বোন ময়নার সাথে প্যাঁচাল না বাড়িয়ে চলে যাচ্ছে। যাবার সময় ঝামেলা বিবি ডাক দিয়ে বলল, ‘তোর কি মাথা নষ্ট অইছে’?
রেনু কথাটা শুনে যেন পুরো আসমানটা মাথার উপর ভেঙ্গে পড়ল। ঝামেলা ওসব কথা কিভাবে জানল। ওরা দু’জনে কথা বলার সময় ঝামেলা বিবি বেড়ার আড়ালে দাঁড়িয়ে শুনছিল। কিন্তু ময়না রেনু জানে না। রেনু কোন বাচন আননে বের না করে নয়ন ভরা ছল ছল অশ্র“ ওড়নার আঁচলে মুছতে মুছতে চলে গেলো।
মাস খানেক পরের কথা।
গরু-মহিষ রাখার মৌশুম শেষ হয় নাই। রাখাল পাড়ায় তেমন সানঘাতিক কোন অঘটন ঘটে নাই। যা ঘটেছে তা শুধু মনুর রাখ্খালি রাখা খালেক প্যাদার শীর্ণ দেহের একটি আধা বয়সী গরু মশার কামড়ে মরে গেছে। তবে তার জন্য মনুকে কৈফিয়ৎ করতে হয় নাই। কারন খালেক প্যাদার ধারণা ছিল শুকনো দেহের গরুটা এবার বাঁচবে না-তা সত্যি হলো। মনু সকাল বেলা গঙ্গামতির চরে পৌছে দেখল গরুটা মরে গেছে। তখনই চলে গেছে খালেক প্যাদার আবাসনে। প্যাদার কাছে বলল। প্যাদা বলে দিলো বঙ্গোপসাগরের জলে ফেলে দিতে। একটু একদিকে স্বস্তি পেল অন্যদিকে অস্বস্তি অনুভব করল। মরু গরুটা নিয়ে কৈফিয়ৎ করতে হয় নাই- সেজন্য স্বস্তি পেল। আর খালেক প্যাদা ধনী বুদ্ধিমান লোক মরা গরুটা সাগরের জলে ভাসিয়ে দিতে বলল-সেজন্যই অস্বস্তি পেল। মনুর অজানা ছিল না সমুদ্রে বুকে অগনিত জেলে মাছ ধরতে যায়। মরা গরুটা সাগরের তোয়ে ফেললে জেলেদের লোকসান ছাড়া লাভ হবে না। মহাজনের সাথে বাড়তি কথা না বলে চলে আসল গঙ্গামতির চরে। মনুর আসারকালে রাখাল পাড়া হতে একটি কোদাল ও একটি ধারারো ভোজলি নিয়ে এসেছিল। ভোজলি দ্বারা মরা গরুটির চমড়া খুলে হায়দার আলীকে পাঠিয়েছিল চাপলীর হাটে। ওরা সবাই মিলে কোদাল দিয়ে মাটি খুঁড়ে মাটিচাপা দিয়ে রাখল চামড়া খোলা মরকটি জঙ্গলের গহিনে।
হ্য়াদার আলী একশত টাকায় চামড়াটি বিক্রি করে পাঁচ টাকা বিড়ি ও দিয়াশলাই কিনে আসল। ইচ্ছা করে এনেছে তাহা নয়- যাবারকালে ওরা বলে দিয়েছিল। হায়দার বিড়ি দিয়াশলাই দিয়ে জ্বালিয়ে টানতে টানতে আসল। বাকি টাকা ওরা সমান সমান ভাগাভাগি করে নিয়েছিল। কারো সন্দেহ না হলেও রাছেলের সন্দেহের বাহিরে যেতে পারে নাই হায়দার আলী। রাছেল সন্দেহ করলে হায়দার আলীর কিছুই যায় আসে না। চামড়ার আসল মালিক মনু। রাছেল প্রকাশ্যে কিছু বলে নাই। মুনর কানের সাথে মুখ মিশিয়ে ফিস ফিস করে বলছিল যে, ‘একটা বুড়া গরুর চামড়া এত কম টাকায় বেচে ক্যামনে’? কিন্তু রাছেলের কথায় কোন লাভ হলো না। মনু ওকথা বলতে বারণ করে দিয়েছে। বুড়ো হায়দার আলী কষ্ট করে প্রচন্ড গরমের মধ্যে পায়ে হেটে, মুড়ি ভাজা বালুর মতো পথের গরম বালুতে হেটে বিক্রি করেছে। মনু বলে দিলো, ‘দু’চার টাকা মিথ্যা কইয়্যা খাইলে খায়ুক’।
হায়দার আলী মিথ্যা কথা বলার লোক না, কোন দিন প্রমান মেলে নাই। মনু আর রাছেল কানে কানে ফিস ফিস কি বলেছে, হায়দার আলী
তা কর্ণপাত করে নাই। সকলে বিড়ি জ্বালিয়ে টান দিয়ে ধোয়া ছেরে ‘ধোয়ায় ধূলিস্বাদ বানালো গঙ্গামতি চরের কিছুয়াংশ’।
কিছুক্ষণ পরে বিড়ি টানা থেকে বিরত হয়ে দাঁড়িয়ে গনি দেখল বেন্দি জালেল নৌকা কিনারায় আসতেছে। গনি কথামতো রহনা দিলো মাছ পেয়েছে কিনা দেখার জন্য। ওদের যেতে যতক্ষন সময় ব্যয় হলো ততক্ষনে জেলেরা সাগরের মোহনার খালের গোড়ায় নৌকা ভিড়ল। মাছ যা পেয়েছে মন্দনা-কাঁকড়া পেয়েছে পর্যাপ্ত। গনি লোভ সামাল দিতে না পেরে কয়েকটা কাঁকড়া আপত্তি করে চাইল। বিমূখ করে দিলো না জেলেরা। গনি, রাছেল, মনু ও সেকান্দার পছন্দ করে বেশ কয়েকটা মস্তকওয়ালা মেদি কাঁকড়া লইল। কাঁকড়া নিয়ে লাফাতে লাফাতে আসল। ভয়ের কিছুই নাই কাঁকড়ার আক্রমান্তক পা বুদ্ধি করে ভেঙ্গেছে ওরা। কামড়াতে পারবে না নিশ্চত হলো ওরা। বুড়ো হায়দার আলীর লোভের কমতি ছিল না। সবাই উৎসাহিত হয়ে গাছের শুকনো ডাল ও ছন খোঁজ করে দিয়াশলাই দিয়ে জ্বালানো আগুনে কাঁকড়াগুলো পোড়া দিল।
কিছুক্ষন পর মনু একটা শক্ত কাঠের লাঠি হাতে নিয়ে কাঁকড়া পুড়ার কুন্ডলীর মধ্যে থেকে অগ্রমী একটা বের করল। হায়দার আলী দেখে বলে, ‘অইয়্যা গ্যাছে ’।
সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত কাঁকড়া বের করে গিলতে আরাম্ভ করল। হায়দার আলী বুড়ো হলে হবে কি ? ওদের সাথে তাল মেলে খাওয়া থেকে বিরত থাকল না। ভারি মজা করে গিলল ভাগাভাগি করে। ততক্ষনে অতিরশ্মি বর্শিত সূর্যটা একদম কাছে আসল ঠিক মাথার উপরে। গরু-মহিষগুলো জঙ্গল থেকে বের হয়ে রাখালদের খনন করা ইন্দিরায় (কূয়া) তৃষ্ণা নিবারণের জন্য পানি খেতে ইন্দিরার পাশে পাশে জমায়েত হলো। কোনটা তৃষ্ণা নিবারণ করে গাছের ছায়ায় শুয়ে পরছে। যখন সমস্ত গরু-মহিষ আলাদা গাছের নিচে শুয়ে পড়ল। তখন মনুরা দুপুরের খানা খাইতে গঙ্গামতির রাখাল পাড়ায় চলে আসল। এক এক জনের হাতে একটা বিড়ি, বিড়ির মোচাটা হায়দার আলীর কোছায়। গহিন জঙ্গল পাড় হয়ে রাখাল পাড়ায় শূন্য হাতে পৌছল। আজ কারো হাতে কোন লাকড়ি নাই।
দুপুরের খানা গিলে মনু রাস্তায় বড় তেঁতুল গাছের তলায় প্রতিক্ষায় রইল। অল্প সময়ের মধ্যে এক এক করে সবাই একাত্রিত হয়ে গঙ্গামতির চরে চলে গেলো। এতক্ষনে গরু-মহিষের পাল জঙ্গলে চলে গেছে রুজির সন্ধানে লতাপাতা গিলতে। ওরা সবাই গরু-মহিষ খোঁজ করে কোথায় গেছে নিশ্চিত হয়ে নিত্যদিনের আড্ডাস্থানে গিয়ে বসল। রাছেল আচমকা বলে উঠল,
‘ম্যালা দিন অইছে চাড়াপাতি খেলি নাই’।
সবাই সায় দিয়ে হই... উল্লা... করে উঠল। কিন্তু চাড়াপাতি খেলতে চাড়া পাবে কোথায় ? মনু একটা উপায় খুঁজে পেলো। যারা বাগদা চিংড়ির পোন বা রেনু ধরে তাদের মাটির ভাঙ্গা হাড়ি থাকতে পারে। সবাই মনুর মেরুদন্ডে ছোট্ট ধাক্কা দিয়ে বলে “উত্তম বুদ্ধি”। চলে গেলো বাগদা চিংড়ির পোনা ধরা জেলেদের নৌকার ছোইয়ের মতো ছনের বাসায়। মাটির হাড়ি ভাঙ্গার চাড়ার অভাব নাই। যতখুশি তত নিয়ে আসল প্রসারিত মৌফল গাছের তলায়। মৌফল গাছের তলায় ফিরে আসার পথে দিয়াশলাই এর খোসা কুঁড়াতে কুঁড়াতে কম পায় নাই। শুরু হলো চাড়াপাতি খেলা।
চাড়াপাতি খেলছে এভাবে-প্রথমে শক্ত লাঠি বা চাড়া দ্বারা মাটিতে একফিট চওড়া গোল দাগ কেটে কুন্ডলী দেয় ওরা।ওদের ভাষায় ঘর বা কোট বলে থাকে। একজন ছাড়া অন্যরা মাটির পাতিলের ভাঙ্গা ছোট্ট গোল চাড়া কুন্ডলীর তফাতে পাক্কা মারে, হাতের মুঠোয় দিয়াশলাইয়ের খালি খোসা যত খুশি গুজিয়ে রাখে। বাকী জনের সাহস হলে হাতের গোল চাড়াটা একজনের তফাতে থাকা চাড়া ছুঁইতে মারবে। দুটো চাড়ার ফাঁকে ওদের হাতের চার আঙ্গুলের বেশী ফাঁকা থাকলে- হাতের মধ্যে গুজানো কতটা দিয়াশলাইয়ের খোসা আছে ততটা গুনে দিতে হবে। আর যদি চার আঙ্গুলের কম ফাঁকা থাকে-তাহলে হাতের মধ্যে গুজানো সব কয়টা শিয়াশলাইয়ের খোসা দিতে হবে। যার চাড়াটা ছুঁতে অসাহস হবে তাকে উল্টো কুন্ডলীতে ফিরে আসতে বলবে, তখন মুষ্টে লুকানো দিয়াশলাইয়ের খোসা থাকবে। কুন্ডলীর মধ্যে অথবা চার আঙ্গুল কম ফারাকে থাকলে মুঠের লুকানো খোসা দিতে হবে। আর তার চেয়ে বেশী ফাঁকা থাকলে লুকানো খোসা গুনে দিতে হবে। যার হাতের খোসা ফুরিয়ে যাবে তার খেলার সুযোগ থাকবে না। যদি কেউ দয়া করে কর্জ দেয় তাহলে তো কথা নাই। এভাবে খেলতে খেলতে যে সবার দিয়াশলাইয়ের খোসা নিতে পারবে সে হবে পাক্কা খেলাড়–। চাড়াপাতি খেলায় গনি পাকা-সবাইকে কুজ করেছে। সকলের দিয়াশলাইয়ের খোসা নিতে নিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্যাশিয়ার হয়ে গেছে। কত খোসা হয়েছে নিজে গুনতে পারে না।
যতক্ষনে চাড়াপাতি খেলে সবার হাতের খোসা গনি নিজের আয়ত্বে নিয়েছে ততক্ষনে অতিরশ্মির বর্শিত সুর্যটা দুর্বল হয়ে পশ্চিম আসমানে বাংলাদেশের সীমানা অতিক্রম করে ভারতের সীমানায় সাগরের জলে ডুবে যাবে যাবে ভাব। গবাদি পশুগুলো জঙ্গল থেকে বের হয়ে ছন ভিটায় আগমন করেছে। হায়দার আলীর নেতৃত্বে সকলে চার দিক থেকে তাড়িয়ে বঙ্গোপসাগরের কূলে স্যাঁতেস্যাঁতে বালুতে রেখে গঙ্গামতির রাখাল পাড়ায় চলে আসল।
পুরো আসমানে তারকা ভর্তি। সোনালী চাঁদ রূপালী আলোতে প্রকৃতি আলোকিত করেছে। চাঁদের কোথাও কোন কলংক নাই। আসমানে মেঘের কোন আবাস নাই। মনে হয় মেঘ যেন আসমান থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেছে পাহাড়ি এলাকায়। এমন রাতে কার চোখে ঘুম আসে? কার না দেখতে মন চায় নয়ন মেলে প্রকৃতির রূপ? রাখাল পাড়ার ছেলে-বুড়ো সবাই আজও কেচ্ছার আসর জমিয়েছে। কিন্তু রাখাল পাড়ার বাঁশ বাগানে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক কার না ভাল লাগে? ঝি ঁঝিঁ পোকা আনন্দের ডাক ডাকে নাকি বেদনার ডাক ডাকে তা কে জানে ? রাখাল পাড়ার সবাই যখন অভাব-কষ্ট, ব্যাথা-বেদনা ভুলে গিয়ে মনে প্রানে আনন্দ সঞ্চায় করে কেচ্ছা বা গল্পের আসর জমিয়ে তুলল তখন রাখাল পাড়ার রাখাল দল ঝিঁ ঝিঁ পোকা ধরতে বাঁশ বাগানে চলে গেলো। ঝিঁঝিঁ পোকা ধরার কৌশল রাখাল দলের অজানা নয়। তবে কোন কালে কোন মানব আবিস্কার করেছে তা অদ্যাবধি কেউ বলতে পারে নাই।
আবিস্কিত কৌশল মতে ওরা সকলে হাতে দু’টি ভাঙ্গা চাড়া নিয়ে গায়ের ছিড়া জামা কোড়তা যার যা ছিল খুলে খালি শরীরে বাঁশ বাগানে প্রবেশ করে হাতের চাড়া দুটো টোক্কা দিতে আরাম্ভ করল। যেমনভাবে দু’হাতে করতালি দেওয়া হয় অথবা বাদ্যযন্ত্রের চাকি যেভাবে বাজানো হয় ঠিক সেভাবে। মুখে গান কয় “ আয় ঝিঁ ঝিঁ আয়, তোর মায় তোরে থুইয়া ডাইল ভাজা খায়”। ঝিঁ ঝিঁ পোকা শত্র“ নাকি বন্ধু মনে করে চাড়া বাজানোর শব্দ শুনে শরীরে পড়ে। খালী গায়ে পোশাকবিহীন শূন্য শরীরে টের পাওয়া যায়, অমনি ধরে ফেলে ওরা। কিছু সময় দু’চারটা ধরে সবাই কেচ্ছার আসরের কাছে উঠানে এসে গনি গান ধরল।
‘ঝিঁ ঝিঁ পোকা ধরছি মোরা
চার পাঁচটা সবাই মিলল্যা
গান বাজামু পোকা দিয়া
‘ঝিঁ ঝিঁ বোলবে ‘ঝিঁ ঝিঁ হরইর্যা।
ভাইঙ্গা যাইবে কেচ্ছার বৈঠক
যে যার ঘরে যাইবে
ভাত খাইবে পেট ভাইর্যা
হাতের তামাক হালাইয়্যা দিয়া”।
হায়দার আলী একটা ধমক দিয়ে বলে,‘ঝাউরা পোলাপাইন দূরে যা’। কারণ আজ কেচ্ছা চাঁনমিয়া মজার কেচ্ছা। সবার হা করে চেয়ে আছে চাঁনমিয়ার মুখের পানে। শুধু কেচ্ছাই শুনতে আছে সকলে টা টু কোন শব্দ নাই। চাঁনমিয়া ঠান্ডা মস্তিস্কে কেচ্ছা কাহিনী বলতে আছে। হাতের ধরানো বিড়িটা কখন যে নিভে গেছে, চাঁনমিয়া নিজেও জানে না। বিশাল মস্ত বড়ো কেচ্ছা। চাঁনমিয়ার কেচ্ছা যখন শেষ হলো তখন চাঁদ গোলাকৃত আসমানের মাঝখানে কিরণ ছড়াতে কৃপণতা করছে না। এতক্ষনে রাখাল দল ঝিঁ ঝিঁ পোকা হাকিমপুরী জর্দ্দার বাটার ভরে ফূর্তিতে গান শুনছে কেচ্ছার আসরের তফাতে বসে। মনু বলে, ‘ বুড়ারা গপ্পের আসর জমাইছে, মোরা জমাইছি কি ’?
গনি বলে, ‘ঝিঁ ঝিঁ পোকার গানের আসর”।
ঝিঁ ঝিঁ পোকা গান করিতেছে না প্রানে বাঁচার জন্য আকুতি করছে তা কি ওরা যানে ? রাত্র যতই গভীর হচ্ছে ঘুমের আক্রমনে ততই সবাই আক্রান্ত হচ্ছে। কারো কারো চোখ ছোট হয়ে গেছে। কিন্তু চাঁনমিয়া কেচ্ছা শেষ করে না। কিছুক্ষনের মধ্যে কেচ্ছার আসর শূন্য করে যে যার ঘরে চলে গেলো।
সাঁঝের বেলা ঘুম থেকে উঠতে সকলের দেরি হলো। কিন্তু নামাজ-রোজায় পটু চাঁনমিয়ার ফজরের নামাজ আদায় করতে ভুল হয় নাই। আজ চাঁনমিয়া কাউকে ঘুম থেকে ডাকাডাকি করে জাগায়নি। কারন একটা আছে-গত বছর এর জন্য শানু ঘরামীর সাথে ঝগড়া লেগে গেছিল। হাতাহাতি হয় নাই বটে- তবে তার চেয়ে কমও না। শানু ঘরামী যে খোন্তা লয়েছিল হায়দার আলী বারণ করতে না পারলে, একটা পিটান দিতে পারলে, এতোদিনে চাঁনমিয়ার শরীরে গঙ্গামতির আলো বাতাস লাগত না। লাগত আতর-গোলাপজলের গন্ধ। রাখাল পাড়ার গোরস্থানে শুয়ে থাকতে হতো। কবরের উপরে দুলবা ঘাস আর বাঁশ জন্ম নিত। আর শানু ঘরামীকে রাখাল পাড়ায় খোঁজ করে পাওয়া যেত না, পাওয়া যেত জেলহাজতে, আসামীর কাট কুড়ায়, শরীরে থাকত কয়েদি পোশাক। শানু ঘরামী শান্ত মনের লোক বটে- কিন্তু নামাজ রোজার ধারে কাছে যায় না। একবার রাগ উঠলে বারণ করা কষ্টের ব্যাপার। চাঁনমিয়া ঐ কথা মনে করে কাউকে ভোরবেলা ডাকে না তাহা নয়-ডাকে নিজের পরিবার ঝামেলা বিবি, পোলা সাজু-মজুরে এবং ভাইয়ের ছেলে মনুরে।
শানু ঘরামীর চেয়ে চাঁনমিয়ার বয়স কমপক্ষে পাঁচ বছরের বেশী। বয়সের বিচেনা করে শালিশ করল সমাজপতি হাসেম জোমাদ্দার। শালিশে সিদ্ধান্ত হলো পাঁচটা বেত। হাসেম জোমাদ্দার বাঁশের শক্ত কঞ্চি নিয়ে সায়েস্তা করার মনস্তাব করলে চাঁনমিয়া বারণ করে বলে, ‘মুই ওনারে মাফ করিয়া দিছি’।
হাসেম জোমাদ্দার শান্ত হয়ে নির্দেশ দেয় চাঁনমিয়ার পায়ে হাত দিয়ে শানু ঘরামীকে ক্ষমা চাইতে। শেষ মুহূর্ত তাও হলো না। শানু ঘরামী চাঁনমিয়ার পায়ের কাছাকাছি পৌছলে চাঁনমিয়া তাও বারণ করে। সেই থেকে সবাই চাঁনমিয়ার কথা শুনে- শ্রদ্ধা করে। যতই শ্রদ্ধা করুক চাঁনমিয়া কারো ঘুমে ব্যঘাত ঘটায় না। কে নামাজ পড়ল, কে না পড়ল চাঁনমিয়া তার খোঁজ রাখে না। সূর্যটা যখন রাখাল পাড়ার পুবে হাসেম জোমাদ্দারের পুকুর পাড়ে লম্বা তাল গাছটার উপড়ে উঠে অতিরশ্মি ছড়াতে আরাম্ভ করলে, সূর্যর তাপ কুটিরে প্রবেশ করল এমন সময় সবাই ঘুম থেকে জাগল। রাখাল দল গঙ্গামতির চরে চলে গেলো। রাখাল পাড়ার গৃহ বধূরা হাড়ি-পাতিল মাজতে গেছে বাড়ির আঙ্গিনায় যেখানে চুলার ছাই ফালানো আছে। গৃহবধুদের আজ হড়ি-পাতিল মাজা, ভাত-ব্যানুন রাঁন্না করা ছাড়া তেমন কোন কাজ নেই।
গনি বলে, ‘ঝিঁ ঝিঁ পোকার গানের আসর”।
ঝিঁ ঝিঁ পোকা গান করিতেছে না প্রানে বাঁচার জন্য আকুতি করছে তা কি ওরা যানে ? রাত্র যতই গভীর হচ্ছে ঘুমের আক্রমনে ততই সবাই আক্রান্ত হচ্ছে। কারো কারো চোখ ছোট হয়ে গেছে। কিন্তু চাঁনমিয়া কেচ্ছা শেষ করে না। কিছুক্ষনের মধ্যে কেচ্ছার আসর শূন্য করে যে যার ঘরে চলে গেলো।
সাঁঝের বেলা ঘুম থেকে উঠতে সকলের দেরি হলো। কিন্তু নামাজ-রোজায় পটু চাঁনমিয়ার ফজরের নামাজ আদায় করতে ভুল হয় নাই। আজ চাঁনমিয়া কাউকে ঘুম থেকে ডাকাডাকি করে জাগায়নি। কারন একটা আছে-গত বছর এর জন্য শানু ঘরামীর সাথে ঝগড়া লেগে গেছিল। হাতাহাতি হয় নাই বটে- তবে তার চেয়ে কমও না। শানু ঘরামী যে খোন্তা লয়েছিল হায়দার আলী বারণ করতে না পারলে, একটা পিটান দিতে পারলে, এতোদিনে চাঁনমিয়ার শরীরে গঙ্গামতির আলো বাতাস লাগত না। লাগত আতর-গোলাপজলের গন্ধ। রাখাল পাড়ার গোরস্থানে শুয়ে থাকতে হতো। কবরের উপরে দুলবা ঘাস আর বাঁশ জন্ম নিত। আর শানু ঘরামীকে রাখাল পাড়ায় খোঁজ করে পাওয়া যেত না, পাওয়া যেত জেলহাজতে, আসামীর কাট কুড়ায়, শরীরে থাকত কয়েদি পোশাক। শানু ঘরামী শান্ত মনের লোক বটে- কিন্তু নামাজ রোজার ধারে কাছে যায় না। একবার রাগ উঠলে বারণ করা কষ্টের ব্যাপার। চাঁনমিয়া ঐ কথা মনে করে কাউকে ভোরবেলা ডাকে না তাহা নয়-ডাকে নিজের পরিবার ঝামেলা বিবি, পোলা সাজু-মজুরে এবং ভাইয়ের ছেলে মনুরে।
শানু ঘরামীর চেয়ে চাঁনমিয়ার বয়স কমপক্ষে পাঁচ বছরের বেশী। বয়সের বিচেনা করে শালিশ করল সমাজপতি হাসেম জোমাদ্দার। শালিশে সিদ্ধান্ত হলো পাঁচটা বেত। হাসেম জোমাদ্দার বাঁশের শক্ত কঞ্চি নিয়ে সায়েস্তা করার মনস্তাব করলে চাঁনমিয়া বারণ করে বলে, ‘মুই ওনারে মাফ করিয়া দিছি’।
হাসেম জোমাদ্দার শান্ত হয়ে নির্দেশ দেয় চাঁনমিয়ার পায়ে হাত দিয়ে শানু ঘরামীকে ক্ষমা চাইতে। শেষ মুহূর্ত তাও হলো না। শানু ঘরামী চাঁনমিয়ার পায়ের কাছাকাছি পৌছলে চাঁনমিয়া তাও বারণ করে। সেই থেকে সবাই চাঁনমিয়ার কথা শুনে- শ্রদ্ধা করে। যতই শ্রদ্ধা করুক চাঁনমিয়া কারো ঘুমে ব্যঘাত ঘটায় না। কে নামাজ পড়ল, কে না পড়ল চাঁনমিয়া তার খোঁজ রাখে না। সূর্যটা যখন রাখাল পাড়ার পুবে হাসেম জোমাদ্দারের পুকুর পাড়ে লম্বা তাল গাছটার উপড়ে উঠে অতিরশ্মি ছড়াতে আরাম্ভ করলে, সূর্যর তাপ কুটিরে প্রবেশ করল এমন সময় সবাই ঘুম থেকে জাগল। রাখাল দল গঙ্গামতির চরে চলে গেলো। রাখাল পাড়ার গৃহ বধূরা হাড়ি-পাতিল মাজতে গেছে বাড়ির আঙ্গিনায় যেখানে চুলার ছাই ফালানো আছে। গৃহবধুদের আজ হড়ি-পাতিল মাজা, ভাত-ব্যানুন রাঁন্না করা ছাড়া তেমন কোন কাজ নেই।
গঙ্গামতির রাখাল দল চাড়াপাতি খেলা ছাড়া নতুন কোন খেলা আবিস্কার করে নাই। বিরামহীনভাবে চাড়াপাতি খেলছে, বুড়ো রাখাল হায়দার আলী নিরবে ওদের খেলা উপভোগ করছে। কারো খেলায় কোন ভুল ধরা পরলে বকনী দিচ্ছে। অনেকক্ষন খেলতে খেলতে গনি ও রাছেলের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হলো। হাতাহাতি শুরু হইল সমানে সমান ভাবে একবার গণি উপরে আবার রাছেল উপরে। মনু ও সেকান্দার বারণ করতে পারল না। হায়দার আলী উঠে দু’জনের পিঠে থাপ্পর দিয়ে থামিয়ে দিলো। সঙ্গে সঙ্গে দু’জনের অভিযোগ শুনে অল্পতেই মিমাংসা করে কোলাকুলি করিয়ে দিলো। অল্পতেই আবার বিরোধ ভুলে গিয়ে ফিরতি চাড়াপাতি খেলতে আরাম্ভ করল। গণি চাড়াপাতি খেলায় পটু হলেও রাছেলের খামখেয়ালিপনা মেনে নিতে পারে না। সব সময়ই খামখেয়ালিপনা করে বদমাশ রাছেল।
এতক্ষনে মনুর গরু-মহিষের ছয়টা গরু বাস্তহারা গ্রামে শ্রীকান্তের বাড়ি প্রবেশ করে পুঁইশাকের মাচা ভেঙ্গে দিয়ছে। শ্রী কান্তের বউ চন্দনা রানী দেখে বলে, ‘হায়রে হায় একি ! গরু কাগো আমাগো পুঁই জাহা শেস হইয়্যা গেলোরে’। শ্রী কান্তের পোলা গৌরঙ্গ ও নিরাঞ্জন গরু ধরে দড়ি দ্বারা কড়াই গাছের সাথে বেঁধে রাখল। মধ্যহ্ন হওয়ার পূর্বে সকল গরু-মহিষ জঙ্গল থেকে ফিরতে এসে ইন্দিরায় তৃষ্ণা নিবারণ করল। গরু-মহিষের হিসেবে পাঁচটা পাওয়া গেলো না। গেল কোথায় ? জঙ্গলের আশেপাশে খোঁজাখুঁজি করল অনেকক্ষন, পাওয়া গেল না। সকলের ধারণা বাস্তহারা গ্রামে যাইতে পারে। বুড়ো হায়দার আলীকে সঙ্গে নিয়ে বাস্তহারা গ্রামে চলে গেলো। গ্রামের পশ্চিম পাশ দিয়ে ডুকেই দেখতে পেলে প্রথম বাড়ির পরের বাড়ির উঠানের পাশে একটা প্রকান্ড কড়াই গাছের পাশে গলায় দড়ি।
শ্রী কান্তের বউ চন্দনা রানী ওদের ভাব সাফ, হাতের লাঠি, মাথায় প্যাঁচানো গামছা দেখে বুঝতে বাকি রইল না- ওরা কারা? পুঁইশাকের মাচা ভাঙ্গাকারী উঠানের পাশে বেঁধে রাখে গরুগুলো ওদের। শ্রী কান্তের বাড়ি চন্দনা রানী ছাড়া পুরুষ যারা আছে কাজের বিরতি দিয়ে বাড়ি ফিরে নাই। পুরুষ শূন্য বাড়ির চন্দনা রানী ওদের উদ্দেশ্যে চেচিয়ে বলল, ‘মোগো পূঁই জাহার বরতুকি না দিলে গরু ছারমু না’।
ওরা কোন কখা বলল না। চন্দনা রানী আবার বলে, ‘গরু-মহিষ বগমানের মানে ছাইর্যা দিয়া ইচ্ছামতো জাউরামী করে, কোন দিকে যায় হেই খবরও রাহে না, কি ক্ষতি যে করছে ! এহন কাম যা........’।
রাখাল দল শ্রী কান্তের বাড়ির একটু তফাতে দাঁড়িয়ে বন্দি গরুর দিকে চেয়ে ফন্দি আবিস্কার করতেছে- কিভাবে আটক গরু মুক্ত করবে ? মুহূর্তের মধ্যে মাথায় পাগড়ির উপরে বড় একটা গামলাওয়ালা পুরুষ বাড়ির ভিরতে প্রবেশ করল। সে আর কেউ নয় শ্রী কান্ত। শ্রী কান্ত বেন্দি জালের মাছ বিক্রি করতে গিয়েছিল চাপলী হাটে। পুঁই মাচার অবস্থা দেখে শ্রী কান্ত অলিকে হাত দিয়ে চুপচাপ বসে রইল। ধীরে ধীরে পা পা হাটি হাটি বুড়ো রাখাল হায়দার আলী শ্রী কান্তের বাড়ি প্রবেশ করল। শ্রী কান্ত বুড়ো হায়দার আলী কে জিজ্ঞাসা করল, গরুগুলো হায়দার আলীর কিনা ? হায়দার আলী ‘হ’ বলল। শ্রী কান্ত পুঁই মাচঙ্গের দিকে তাকাতে বলল। হায়দার আলী আকুতি বৃদ্ধি করে বলে, ‘হ মশাই বিশম ক্ষতি করিয়াছে। বোঝতে পারি নাই এদিকে আইবে, কোনদিন তো আয় নাই। গরু কয়ডা একটা এতিম পোলার’।
এতিমের কথা শুনেই শ্রী কান্ত দরদ দেখিয়ে বলে, ‘গরু লইয়্যা যান আর যানো এদিকে আয় না’।
হায়দার আলী আটক গরু কয়টা ছাড়তে আরাম্ভ করল। শ্রী কান্তের বউ চন্দনা রানী বলে, ‘তুমি কামডা হরলা কি,ছাইয়্যা দিলা’?
শ্রী কান্ত বলে, ‘এতিম পোলার রাখ্খালি গরু’।
চন্দনা রানী বলে, ‘হ্যাতে কি অইছে’।
শ্রী কান্ত ক্লান্ত শরীরে চন্দনা রানীর প্যাঁচাপ্যাচি সহ্য করতে না পেরে বলে, ‘চন্দনা চিল্ল্যাইস না.... নিচুমে থাক, নাইলে একটা লাথি মারুম’।
চন্দনা রানী আর কোন কথা বলে নাই-যা বলেছে মনে মনে উচ্চস্বরে না।
আজ অনেক দিন পর মনু রাখ্খালি গরুর পিঠে লাঠি দ্বারা কয়েকটি পিটান দিলো। গরু কয়টা সোজা গঙ্গামতির চরে ছন ভিটার ইন্দিরায় দৌড়ে গেলো। দেখলে মনে হবে ওরা নিজেদের অপরাধ বুঝতে পেরেছে। এতক্ষনে সূর্যটা পশ্চিম আকাশে ঢলে পরছে। রাখাল পাড়ার পাতিলে রাঁন্না করা ভাত ঠান্ডা হয়ে গেছে। রাখাল দল চর থেকে আসারকালে বঙ্গোপসাগরের মোহনা খালের শাখা জলের গোসল করতে করতে আসল জেলে ঘাটে। তড়িৎ গতিতে খাওয়া-দাওয়া করে একদলে চলে গেলো গঙ্গামতির চরে।
--------------********--------------
No comments