গঙ্গামতির রাখাল-(পর্ব-সাত)

                   গঙ্গামতির রাখাল-(পর্ব-সাত)
Novel Cover Photo
Novel Cover Photo

মাস খানেক পরের কথা।
বাগদা চিংড়ি মাছের পোনা বা রেনু ধরার মৌশুম শুরু হয়ে গেলো। সমুদ্র উপকূলে গঙ্গামতির চরে শত শত জেলে পোনা ধরার জন্য বলই গাছের লম্বা ডাল বাঁকা করে নৌকার ছইয়ের মতো বাসা তৈরী করেছে। উঁচু বালুর দ্রুমে সারিবদ্ধভাবে শত শত বাসা। বাগদা চিংড়ির পোনা মূলত সারা বছর কম বেশী পাওয়া যায় বটে- কিন্তু বিক্রি করার সুব্যবস্থা না থাকার কারনে ধরা হয় না। গঙ্গামতির রাখাল দল ছাড়া অন্যরা পোনা ধরার জন্য বাসা দিয়েছে। চাঁনমিয়া ওদের চারজনের জন্য চারখানা পোনা ধরার জাল বা নেটজাল চাপলীর হাটের আড়ৎদার রফেজ মিয়ার নিকট থেকে এনে দিয়েছে। গরু-মহিষ রাখার ফাঁকে ফাঁকে খেলাধুলার পরিবর্তে জাল টানবে সাগরের জলে। পোনা ধরার কৌশল বিভিন্নভাবে আবিস্কার করেছে ক্ষুদ্র জেলেরা। পোনা ধরার জালের চাক বানানো হয় সরু স্বাভাবিক মোটা গাছ বা বাঁশ হাত চারেক লম্বা, দু’মাথায় হাত খানেক চ্যাড়া দুই- আড়াই ইঞ্চি ডামিশ লোহা বা দড়ি দ্বারা বেঁধে, চ্যাড়াটার বাঁশের বিপরীত পাশে হাত দুই লম্বা আর একটা বাঁশের চ্যাড়া আড়াআড়ি বাশেঁর সাথে ডামিশ মেরে চাক তৈরী করে জাল লাগানো হয়। চাকের চার কোনে রশি বেঁধে লম্বা করে কোমড়ের সাথে জড়িয়ে টানা হয় সাগরের জলে হাঁটু-কোমড় বুক বরাবর ভিজিয়ে। কেউ বা আবার চাক বানায় দুটি লম্বা বাঁশের সাথে আড়াআড়ি চ্যাড়ায় ডামিশ মেরে। একটা বাঁশ ওয়ালা গুলোকে এখানকার লোকজন একগুতা বাট বলে। আল দুই বাঁশ ওয়ালা গুলোকে চঙ্গা বাট বলে। পোনা ধরার জন্য জাল বানানো হয় চার/পাঁচ গজ নেট জাল দিয়ে।

কেউ কেউ চিংড়ির পোনা ধরে সাগরের কূলে একটা গেরাপি বা খুঁটি পুতে  আর একটা সাগরের শেষ ভাটার পানিতে পুতে। একটি লম্বা মোট দড়ি টানিয়ে মাঝখানে সাত আটটা খুটি মজবুত করে পুতে টানা দিয়ে, যাতে দড়ি জোয়ার ভাটার স্রোতে ছিড়ে না যেতে পারে। টানানো দড়ির সাথে ফাঁক ফাঁক করে পনের বিশ খানা নেট জাল বেঁধে রাখে, কিছু সময় পর পর পাতিল বা হাত খুচইন নিয়ে খ্যাও তোলে। বাগদা চিংড়ির পোনা ধরতে বেন্দি জাল ব্যবহার করা হয় না-তা নয়। তবে মোহনার খালে সাগরে না। কারন সাগরের পাহাড় সমান উঁচু তরঙ্গে বেন্দিজাল পাতলে রাখা যায় না। কেউ আবার জাল পাতে একটা লম্বা বাঁশের দু’মাথায় দুটি দড়ি ও মাঝখানে একটি দড়ি লম্বা করে গেরাপি মেরে। এতে একসাথে তিনটি জাল পাতা যায়।

গঙ্গামতির রাখাল দল ওসব কৌশলে চিংড়ির পোনা ধরে না। শুধু কোমড়ে বাজিয়ে কূলে কূলে টানে অবসর সময়ে। রাখাল দল রাখাল পাড়ায় ফিরে আসার সময় ওদের সমস্ত মালামাল শানু ঘরামীর বাসায় রেখে আসে। ওরা রাত্রে পোনা ধরে না তাহা নয়- ধরে তবে ডালায় না জোবায়। জোবায় চার/পাঁচ দিন ভাল পোনা পাওয়া যায়। জালের টোনে যা ওঠে কূলে এনে তা একটি বড় গামলার পানি ভর্তি করে পানির মধ্যে ডেলে একটা সাদা টিনের থালে গামলা থেকে পানি তুলে মরা ঝিঁনুকের এক পাট বা ইলিশ মাছ ধরার জেলেদের জালের ভাসমান ফুল্টু কেটে ঝিঁনুকের মতো তৈরী করে পোনা বেছে বেছে মাটির হাড়িতে রাখে। পোনা ধরার গোন শেষ হয়ে  গেলে ওরা ক্রেতার কাছে বিক্রি করে।

রাখাল দল আর ওদের বয়সী টক-বগে যুবকরা হা-ডু-ডু খেলে স্যাঁতস্যাঁতে বালুর উপর শুকনা বালুতে অস্থায়ী কোট বা সীমানা দিয়ে। আর বাগদা চিংড়ির পোনা ধরার বুড়ো জেলেরা বাসায় বসে বসে তাস খেলে, বিড়ি টানে, কেউ কেউ রাঁন্না করে আর গল্প করে।

বিকাল বেলা কানামাছি খেলাটা ওদের নিত্য চলে। কানামাছি খেলাটা ওরা মেয়েদের মতো শখ করে খেলে। মাঝে-মধ্যে বেী ছি.. খেলে দুই একজনের অনুরোধে। আজকের বিকালে বৌ ছি.. খেলায় মনুরে বৌ বানানো হয়েছে। মনু বৌয়ের ঘরে বৌ সেঁজে বসে গান ধরল।
‘বৌ-ছি.. মোর ভাল লাগে
হ্যাইতে মোরে বৌ বানাইছে,
সুযোগ পাইলে দৌড় দিয়া
মুই যামু আর এক ঘরে।
মাইর দিতে না পারলে
ছিট হবে গুইন্যা লাখমু
বৌ-ছি.. মোর ভাল লাগে
খেলামু তাই নিত্য বিয়ালে।

হা-ডু-ডু, কানামাছি বোঁ বোঁ, আর বৌ-ছি.. খেলার মধ্য দিয়ে কয়েকটা বিকাল কেটে গেল। আচমকা সাগর হতে বাগদা চিংড়ি মাছের পোনা উধাও। অল্প অল্প যা পাওয়া যায় তাতে খাওয়া চলে না। পাঁচ-ছয় দিন গত হলো পোনা বা রেনুর সন্ধান এখনও মেলে নাই। আর কিছু দিন এভাবে চললে ভাত রাঁন্নার হাঁড়িতে মাকরশায় জাল বুনবে, বিড়াল তো নাই গঙ্গামতির চরে উনুনে খেকশিয়াল পালাবে। এই হিসাব নিকাশ করে তফাতের জেলেরা চলে গেছে গ্রামের বাড়িতে। কিন্তু গঙ্গামতির জেলে ও রাখালরা যাবে কোথায়? তারা চাকুরী বদল না করে পূর্বের কাজে বহাল থাকল। যারা চলে গেছে তার একেবারে চলে গেছে তা নয়-আবার আসবে পোনা মাছের দেখা মিললে।

লোকজন চলে যাবার কারনে তিন খেলা বন্ধ। হঠাৎ মনুর মনে পড়ল ‘কাটা বহরীর’ মৌশুম চলছে। গত বৎসর রাখালদের আড্ডার একটু তফাতে ‘কাটা বহরী’র বাগানে মনু ‘কাটা বহরী’ খেয়েছে। রাখালরা বুড়ো হায়দার আলীরে যথাস্থানে রেখে সাঁই সাঁই করে ‘বহরী’ বাগানে চলে গেলো। কাটা বহরী বলা হয় তার একটি কারন আছে- ‘বহরী’ গাছ লম্বা লম্বা কাটাযুক্ত তাই। ‘বহরী’ আকারে ছোট হলেও খাইতে ভারী মজা। ফলটা কাচা পাতা রংয়ের পাকলে লালচে দেখায়-একটু বেশী পাকলে কালো রং ধারণ করে। ওরা গিয়ে দেখল ‘কাটা বাহরী’ পেকে লালচে-কালচে হয়ে আছে। ওরা মন মতো খাইল- আর খাবার রুচি নাই। আমানত রাখার মতো ফল না-পেকে বালুতে পরে যাবে। তারপর আবার জঙ্গলের ফল সকলে খাবার অধিকার আছে। ওরা চারজনে পড়নের কাপড়ে টোকরে ভরে আনল ইচ্ছামতো। হায়দার আলী দেখে বেশী খুশি হলো। হায়দার আলী খাইল যত পারল- বাকিগুলো রাখাল পাড়ায় নিয়ে আসল। রাখাল পাড়ার নারী-পুরুষ, ছেলে-বুড়ো যারা ছিল সকলে মজা করে গিলল। রাছেলের বোন শিলা ভাইয়ের কাছে আপত্তি করল, যতদিন ‘কাটাবহরী’ পাওয়া যাবে প্রতিদিন যেন ওরা নিয়ে আসে।

একদিন সন্ধ্যার পূর্ব মুহূর্তে রাখালরা গরু-মহিষ জঙ্গল হতে তাড়িয়ে আনারকালে কয়েকটা মহিষ বইল বনে ডুকে পরল। সেকান্দার বলই বনে অগনিত ‘সোনাপোকা’ উড়তে দেখল। ‘সোনাপোক’ ধরার মতো সময় ছিল না। পরের দিন মধ্যহ্নের পূর্বে সকলে বইল বনে চলে গেলো ‘সোনাপোকা’ ধরতে। ‘সোনাপোকা’ ধরার কৌশল আবিস্কার করল- লম্বা লাঠির মাথায় হ্যাতাল গাছের পাতা ছিড়ে একগোছা করে বেঁধে বলই বনে নাড়া দিবে ‘সোনাপোকা’ উড়ে যাবার সময় গোছাবান্দা লাঠি দিয়ে পিটান দিবে, মাটিতে ফেলে সঙ্গে সঙ্গে ধরবে। এতক্ষনে এক এক জনে একটা নয়, দুইটা নয় পাঁচ-ছয়টা করে ধরর। ‘সোনাপোকা’ ধরা ক্ষ্যান্ত দিয়ে জঙ্গলের কিনারায় বালু উঁচু টিলায় বিস্তর বড়ো হাড়্ড়া গাছের তলায় বসে। বলই গাছের বাকঁল তুলে চিকন সূতার মতো করে ‘সোনাপোকা’ এর দুটো পা বইল সূতার মাঝখানে গিটু দিয়ে বেঁধে দোবাজ করে, দোবাজের মাঝখানে অন্য আর একটা লম্বা বলই সূতা বেঁধে দুহাতে ধরল। ‘সোনাপোকা’ প্রানে বাঁচার জন্য উড়তে আরাম্ব করে দিলো বটে- কিন্তু যেতে পারবে না। হাতে বলই সূতার চারপাশে ঘুরতে আরাম্ব করল। ওদের ভাষায় ‘সোনাপোকা’ ঘুরাই। সত্যকথা বলতে- ‘সোনাপোকা’ ওদের খেলনার জন্য ঘোরে নাকি? প্রানে বেঁচে ওদের হাত থেকে উড়ে যেতে চায়। তা কি ওরা যানে ? ‘সোনাপোকা’ উড়লে  শন শন শব্দ হয় তাতেই ওরা যত আনন্দ পায়।

মনু দুপুর বেলা গঙ্গামতির চর থেকে এসে মাটির কলস হাতে নিয়ে হাসেম জোমাদ্দারের কূপে জল আনতে গলো। সেদিনের মতো রেনু আজও গোসল করছে। মনু কিছুক্ষন অপেক্ষা করছে। ততক্ষনে রেনু জামা-পাজামা পরিবর্তন করে হাতে ইশারা দিয়ে মনুরে ডাক দেয়। মনু নলকূপের কাছাকাছি গেলেই রেনু বলে,
‘এতদিন যা দেখছি হ্যাতে তোর পালাপদ্ধতি ভাল না, তুই মোরে বিয়া করবি কিনা হ্যাইডা কয়’?
মনু বলে, ‘মুই বিয়া করমু ক্যান, তোরে বিয়া করবে বড়লোকের পোলারা’।
রেনু বলে, ‘বড়লোক আর ছোট লোক মুই বুঝি না, তোরে মোর ভাল লাগে হ্যাইতে কই’।
এতক্ষনে মনুর কলস কূপের জনে ভর্তি হয়ে গেছে। মনু কলস মাথায় নিয়ে চলে আসল নীড়ে। ততক্ষনে রাছেলের বোন শিলা চাঁনমিয়ার ঘরে এক বাটি লবন দ্বার বা কর্জ নিতে এসেছে। লবন নিয়ে মনুর দরজার সম্মুখ দিয়ে ফেরার সময় মনু ছোট্ট করে তবে তত ছোট না শিলা যেন শুনতে পায়,  বলে, ‘শিলা মোর একটা কথা হুনবি’?
অভিমানি শিলা দাপটে বলে, ‘কি কইবা কও জলদি’।
মনু কি বলবে শিলার রূপের মাঝে নিজেকে বিলিন করে সমস্ত হারিয়ে ফেলছে। একটু সময় করে বলে,
‘থাউক আজই কমু না আর একদিন কমুআনে’।
শিলা চটপট পা বাড়িয়ে চলে যায়। মনে মনে শিলা ভাবে মুন কি বলতে চায়? শিলা ভাবনা থেকে ভাবান্তরে চলে যায় বটে-তবুও কোন কিছু আবিস্কার করতে পারে না।

সপ্তাহখানেক পরে সন্ধ্যা রাতে শিলা হাতে টিপ টিপ জ্বলে থাকা ল্যাম্প লয়ে চাঁনমিয়ার ঘরে যাচ্ছে মনুর দরজার সম্মুখ দিয়ে-কে যানে কি কর্জ আনতে ? মনু ঘরের সামনে প্রকান্ড গাছ খন্ডের উপর বসা। দরজার সামনে বর্ষাকালে হাত-পা ধৌত করার জন্য মনু গঙ্গামতির জঙ্গল থেকে এনেছিল।  মনু বলে, ‘শিলা কথাটা আইজ হুনন্যা যা’।
শিলা বলে ‘হহালে কও’।
মনু বুকের মধ্যে হযরত আলী মতো সাহস সঞ্চয় করে বলে, ‘শিলা তোরে মোর ভাল লাগে’।
শিলা বলে,‘ভাল লাগলে মুই কি হরমু’?
কিন্তু শিলা এমন লজ্জা পেলো যেন ‘লজ্জাপতি’ পাতার মতো বুঝে গেলো। আর কোন কথা বলল না লম্বা পায়ে চলে গেলো চাঁনমিয়ার ঘরে। এদিকে শিলা ও মনুর কথপকথন চাঁনমিয়া নিজের কানে শুনেছে বাঁশ বাগানের পাশে বসে। চাঁনমিয়া বাঁশ বাগানে গোপনে কি করছিল-তা কে যানে ? শিলা লজ্জার জন্য মনুর ঘরের পিছন দিয়ে চলে গোলো নিজের ঘরে। রাতে চাঁনমিয়া মনুর সাথে উক্ত বিষয় নিয়ে আলাপ করা থেকে বিরত থাকল। সাঁঝের বেলা মনুরে ডেকে বলে,‘শিলারে তুই সাধি করবি বাবা’?
মনু বোকা বনে চলে গেলো আচমকা চাঁনমিয়ার মুখে শিলার কথা শুনে। মনু বলে, ‘ক্যান চাচা ওকথা কইলেন ক্যান’?
চাঁনমিয়া বলে, ‘মোর লগে মিথ্যা কইস না, মুই সব জানি’।
মনু শরম পেয়ে চলে আসল নীড়ে। চাচা চাঁনমিয়া কিভাবে জানল মনু তার কি যানে ?

চাঁনমিয়া ভাইর পোলার  দূর্বলতা দেখে শিলার বাপ মোস্তফা আকনের সাথে আলাপ করল। ওনাহ আগ্রহ আছে। হালকা আলাপ হয়েছে বটে- কথাবার্তা পাকাপাকি হয় নাই। দুই একদিন পরে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিবে বুঝ ব্যবস্থা আছে উভয়ের।

এদিকে গঙ্গামতির রাখাল দল নতুন খাদ্যের আবিস্কার করছে। দুষ্ট রাখাল দল একর পর এক দুষ্টমি ঠিক করে রাখে। আজ যা খাইতে রাখাল দল জঙ্গলে প্রবেশ করেছে তা আর কিছুই না ‘লতাফল’। ওদের মুখে শোনা যাবে তেলাচোরা ফল। তেলাফল আর সব্জি বাজারের পোটল তরকারির পাথক্য করা সহজ কাজ নয়। তেলাফল গিলতে স্বাদের কমতি আছে মনে হবে না। লতাবিশিষ্ট তেলাফল গাছ। তেলাফল লতা যে ঔষধি গাছ তাতে সন্দেহের কমতি নাই। মানব দেহের পেটে ব্যাথা নিপাত করার প্রধান কার্যকারী লতা। রাখালরা তেলাফল খেয়েছে অনেক।
এতক্ষনে সূর্যটা মাথার উপরে উঠতে বিশ্রাম নেয়নি। ওরা দুপুরের খানা খেতে রাখাল পাড়ায় আগমন করেছে। ঝামেলা বিবি মনুরে ডাক দিয়ে সম্বন্ধের কথা আলাপ করল। মনু শরম অনুভব করল বটে-কিন্তু যখন শিলা হবে মনুর বউ তখন শরম রেখে লাভ কি ? আবার যখন রাত্রিকালে একা থাকতে হয়। ভাত-ব্যানুন রাঁন্না করে গিলতে হয়, তখন বউয়ের প্রয়োজন কার না হয় ? এসব চিন্তা করে কন্ঠ নরম করে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলে, ‘চাচিমা মুই জানি না, আমনেরা য্যা হরেন’।

মনু আর সময়ের ঘাটতি না করে নিজের ঘরে আসল। চাঁনমিয়া কুটিরে ফিরলেই ঝামেলা বিবি দেবর পোলার মনস্তাব জানাল। চাঁনমিয়া আলহামুলিল্লাহ বলে খাবার খেয়ে বিশ্রাম নিয়ে মোস্তফা আকনের ঘরে উদ্দেশ্যে বের হলো। দু’জনের কথপ কথনে সম্বন্ধের দিন তারিখ ঠিক হলো আগামী মাসের সোমবার। এখনও সতের দিন বাকি। শিলা নিজের সাধির আলাপ শুনে ঘরের পিছনের বড় আম গাছটার বাঁকলে উত্তর মুখি হয়ে বসে রইল। মনে মনে মনুরে নিয়ে শত ভাবনা। মনু যে শিলারে নিয়ে ভাবে না তা নয়। মনু তো অনেক পূর্বের শিলারে নিয়ে ভাবা শুরু করেছে। মনুর মনে প্রেম সৃষ্টির সূচনা লগ্ন থেকেই শিলা। শিলা ছাড়া অন্য কাউকে ভাবতে কষ্ট হয় ওর। মনু যে কেন শিলার প্রতি এত দূর্বল হলো তা কে জানে ? শিলার কোন রূপ মনুরে প্রায় উন্মাদ বানালো তা মনু ছাড়া কে জানে ? মনু আনন্দে দিশেহারা হয়ে যায় বটে-কিন্তু জনশূন্য ছাড়া প্রকাশ পায় না।

পরের দিন বিকালে রেনু চুলের উকুন বাছাতে রাখাল পাড়ায় আসল। শিলা আম গাছের ছায়ায় বসে কি যেন ভাবছে। রেনু সন্নিবেষ্টিত হলো শিলার। রেনু চুলের পোকা বাছতে আকুতি করে বলে, ‘আইছি তোর দারে মাথায়  বিলি দেতে’।
শিলা বলে, ‘আউগাও’।
শিলার সামনে বসল রেনু। চুলের উকুন বাছার ফাঁকে অনেক কথপ কথন হলো। এক পর্যায়ে রেনু জিজ্ঞাসা করল শিলার কাছে,
‘আচ্ছা শিলা ক দেহি এহানে বইয়্যা কি ভাবছিলি’? 
শিলা বলে, ‘কি আর ভাবমু, ভাবছিলাম সাধির কথা’?
রেনু বলে, ‘কার সাধি’?
শিলা বলে, ‘ক্যান তুই হোন নাই, মোর আর মুনর সামনে মাসে বিয়া’?

কথাটা শুনে যেন রেনুর মাথার উপর পুরো আসমান ভেঙ্গে পড়ল। যাকে রেনু এত ভালবাসে, যার সাথে পিরিত করতে চায়, তার সাথে আর একজনের বিয়ের কথা শুনলে কার না মন্দ লাগে ? মনে হয় একজেনের বাড়া ভাত আর একজনে গিলছে। রেনু তড়িগড়ি ঝামেলা বিবির কাছে চলে গেলো। ঝামেলা বিবি তখন বারান্দায় শুকনা মরিচ পাথরের পাটায় পোতা দিয়ে পিশে। রেনু হঠাৎ অস্থির ভাবে জিজ্ঞাসা করল, ‘চাচি আমনে গো মনুন্যার বোলে বিয়া’?
ঝামেলা বিবি ঘুরে রেনুর দিকে মুখ ফিরিয়ে বলে, ‘হ তবে তোরে এরহমেনর লাগছে ক্যান’?

রেনু একটু স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করল বটে-কিন্ত রেনুর মায়াবী কাজল কালো নেমক হারাম চোখ ছল ছল অশ্র“ সামাল দিতে পারল না। চোখের অশ্র“ শ্রাবনের বর্ষার মতো অজয় ধারায় গড়াতে আরাম্ভ করল। ঝামেলা বিবি আশ্চার্য হয়ে গেলো রেনু চোখে অশ্র“ কেন। রেনুর কাছে কিছু জানতে না চেয়ে নিজে নিজে সমাধান খুঁজে পেল যে, মনু যখন বর্ষাকালে ওদের বাড়ি মায়েন্দারি করে তখন হয়তো কিছু একটা হতে পারে। আচমকা রেনু দৌড়ে বাড়ি চলে গেলো। নিজের কামরায় চকির উপরে বালিশে উপ্পুর হয়ে শুয়ে নিরবে মনে মনে বলে, হায়রে মনুন্যা তুই মোর পিরিতের দাম দিলি না? কান অপরাধে তুই মোরে বিয়া হরতে রাজি হইলি না ? আবার ঘৃনা করে বলে মনে মনে বলে, ‘তুই একটা আস্তা নির্দয়া, নিষ্ঠুর, বেঈমান, হারামজাদা। যা যা মোরে তোর বিয়া হরা লাগবে না। তুই শিলারে বিয়া হইর‌্যা না খাইয়্যা মর’। মনে মনে বহু জল্পনা-কল্পনা করে অবেলায় নিশ্চুপ শুয়ে রইল।
রাখাল পাড়ার রাখালদের জন্য প্রকৃতি মৌফল দান করতে কৃপণতা করল না। মৌফল দেখতে প্রায় আড়াই প্যাঁচের মিষ্টান্ন দোকানের জেলাপির মতো। তাই গঙ্গামতির রাখালরা জিলাপি ফল বলে। লম্বা লাঠির আগায় ছোট কাঠি দিয়ে টোকা বেঁধে মৌফল পেরে খাওয়া ওদের প্রতি বছরের নেশা। প্রতি বছরই এই দিনে প্রকৃতিতে আগমন ঘটে গঙ্গামতির চরের অগনিত মৌফল গাছে মৌফল। খাওয়ার নেশা শুধু রাখাল দলের তা নয়- মেয়ে-ছেলে, বুড়ো সকলের। মৌফল গিলতে আর গরু-মহিষ রাখতে রাখতে মনুর সাধির দিন নিকটে আসল।
দেখতে দেখতে মনু ও শিলার আনুষ্ঠানিকভাবে সাধির কাজটা ফয়সালা হয়ে গেলো। এই পাড়ায় মেয়ে-ছেলের সাধি ঝামেলা তেমন হয় কিছু নাই। মনু ও শিলা স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক সামাজিক দৃষ্টিকোন থেকে অর্জন করে সুখের স্বর্গ রচনা করতে আরাম্ভ করল- অভাবকে হাসি মুখে বরণ করে।

রেনুরে দাওয়াত করল শত মনুর বোন ময়না। কিন্তু রেনু রাখাল পাড়ায় আসলে ধামা-চাপা বুকের ব্যাথা আবার দ্বিগুন হয়ে যাওয়ার ভয়ে একবারও আসল না। অথচ রেনুর মা চাতুরী বেগমের আসতে ভুল হয় নাই। রেনু মনের দুঃখ মনে নিয়ে, মনের জমানো ভালবাসা কবর দিয়া হায়াতের দিনগুলি অতিবাহিত করতে লাগল। শত দুঃখ কষ্ট অভাবের মধ্যেও রাখাল পাড়ায় আনন্দের বন্যা বয়ে গেলো। ছেলে-মেয়ে রাখাল পাড়ার আনন্দ নগর বানিয়ে তুলল। মনে হয় দুঃখ-কষ্ট-অভাব রাখাল পাড়ার ফূর্তির কাছে পরাজিত হয়ে জঙ্গলের বিস্তর বড়ো কেওড়া গাছের মগডালে বসে অপেক্ষা করছে। ফূর্তি রাখাল পাড়া ছেড়ে গেলেই আগমন করে বসতি স্থাপন করবে।

রাখাল পাড়ায় আনন্দের স্থায়ীত্ব তিন দিনের ব্যবধানে টিকতে পারল না। গনির অকাল মৃত্যুর কারণে। গনির মৃত্যুটা কেহই সহজ ভাবে মেনে নিতে পারে নাই। টগবগে যুয়ান পোলার মৃত্যুতে রাখাল পাড়ায় শোকের ছায়া নেমে আসল। গনির মৃত্যুর কারনটা প্রকৃতির নিষ্ঠুরতা ছাড়া আর কিছুই হতে পারে বলে মনে হয় না। সেদিন দুপুর হবার আগে রাখাল দল গহিন জঙ্গলের ভিতর থেকে গবাদি পশু তাড়িয়ে আনার সময় চোখের আড়ালে লুকাতেই পারে না বিস্তর বড়ো মধু পোকের বাসাটা। রাখাল দল মধু পোকার বাসাটা দেখে লোভ সামাল দিতে না পেরে মনস্তাব করল বিকালে বাসা থেকে মধু সংগ্রহ করবে। সংগ্রহ করেছে বটে- একজনের প্রান ও দু’জনের অসুস্থ্যতার বিনিময়ে। রাখালরা মধু সংগ্রহের কৌশলে মোটা গেওড়া কচার ডগায় শুকনা ছন গোছা বাঁধে, মধু পোকার বাসার তলায় উই পোকার উঁচু মাটির দুমে দাঁড়িয়ে বাসার তলায় ধান সিগ্ধ করা টিনের ডোঙ্গা পেতে, গোছা ছনে আগুন জ্বালিয়ে বাসার কাছাকাছি ধরল। আগুনের তাপে মধু পোকা তফাতে সরে যায়। গনি হাতে একটা বালতি, ধান কাটা কাচি ও একগোছা রশি নিয়ে বাইন গাছে মধু পোকার বাসার কাছাকাছি পৌছে বাসা কাটা বা মধু সংগ্রহ করা আরাম্ভ করল। সমস্ত মধু সংগ্রহ করার আগে গোছার আগুন নিভে যায়। সঙ্গে সঙ্গে রানী পোকারটার নিদের্শে পোকার দল গণিকে চারদিক হতে ঘেরাও দিয়ে কামড়াতে আরাম্ভ করল। নিচের রাখালরা প্রানে বাঁচল দৌড়ে। দু’চারটি কামড় মনু ও সেকান্দারের শরীরে পড়িল। পোকার কামড়ে শুধু জ্বর ? তিনদিনে পৃথিবীর কথা মনে পরে নাই ওদের। গনি পোকার কামড়ে গাছ থেকে নামতে সক্ষম হয় নাই, ছ্যাছড়িয়ে মাটিতে পরে বাইন গাছের লোনা পানির ধারালো হুলায় সমস্ত শরীর ফুটা হয়ে গেছে। একদিকে পোকার কামড়ে বিষের জ্বালা অন্যদিকে শরীরের ছিদ্র দিয়ে রক্ত প্রবাহিত হয়ে গনির প্রান পাখিটা কোন সময় খাঁচা ছেড়ে উড়ে গেছে তা কেহ বলতে পারে না। অন্যরা তফাতে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করতে পারে নাই। গনির প্রান শূন্য দেহটা ওদের নিয়ন্ত্রনে আনতে ঘন্টা খানিক সময় পার হয়ে গেলো। সারা শরীরে রক্ত মাখা আর পোকার কামড়ে ফুলে গেছে। শরীরে এমন কোন স্থান নাই যেখানে পোকায় কামড় দেয় নাই। রক্তাক্ত-ফুলা- ফুটো প্রান শূন্য দেহটা রাখাল পাড়ায় নিয়ে আসল। অনেকেরই গনির লাশ সনাক্ত করতে কষ্ট হয়েছে। কান্নাকাটি কত হলো তার বিবরণ দিবো কেমন করে ?
তারপর নিয়মিত আয়োজনে রাখাল পাড়ার কবরস্থানে টগবগে যুয়ান গনির লাশটা শুয়ে দিলো মাটির তলে।
গঙ্গামতির রাখাল দল সঙ্গিহারা এক এক করে কম হলো না। আর কত সঙ্গি হারাবে ওরা ? চিন্তাটা সবার চেয়ে মনু বেশী করে। কবে না যানি মনুর প্রান সঙ্গি ছাড়া হয়ে চলে যায় দুর দেশে পরপারে মাটির নিচে।

দিন দশে পর রাখাল পাড়ার শোকের ছায়া দূরীভূত হলো। রাখাল দল গঙ্গামতির চরে গনির পরিবর্তে কাউকে পায় নাই। গনির গরু-মহিষ রাখার দায়িত্ব ওদের উপর অর্পিত হলো।
 “ধন সম্পত্তির নিচ তলার মানুষ হয়েও ওরা মায়া মমতায় ছিলো ধনী পাড়ার উর্ধ্বে”।
রাখাল দল যতই দুঃখ-কষ্ট পায় ওরা দুষ্টামি ভোলে না। রাখাল দল মার্বেল খেলা আরাম্ভ করল। তবে ওদের খেলার মার্বেল হাট বাজারের কোন পণ্যশালায় পাওয়া যাবে না। ওদের মার্বেল গুলো গহিন জঙ্গলের ‘উরমই গাছে” এর ফল। ফলটা পেকে মাটিতে পড়ে বর্ষার বৃষ্টিতে জলের স্রোতে শুকনো পাতার সাথে অজানা ঠিকানায় পাড়ি দেয়। তারপর সাগরের জলে ফলের নরম অংশ পঁচে বিচিটা তরঙ্গে ভেসে ওঠে কিনারায়। সাগরের ময়লা ভেসে আসার স্থানে উরমই বিচি খোঁজ করে মার্বেল খেলা গঙ্গামতি ছেলেদের স্বভাব। রাখালরা তার ব্যতিক্রম নয়। উরমই বিচি দিয়ে মার্বেল খেলায় মনু পাক্কা খেলোয়ার। মনুর চোখের নজর আসমানে উড়ে বেড়ানো শিকারী বাজপাখি ও চিলের মতো নির্ভুল।
রাখালরা মার্বেল খেলতে খেলতে পেটের খিদা অনুভব করে জঙ্গলের একপাশে বেত বাগানে ডুকে আঙুল ফলের মতো ছোট ছোট থোকা বিশিষ্ট কালচে-লালচে ‘বেত ফল’ গিলতে আরাম্ভ করল। তবে এই বেত গাছ দেখতে পাঠশালার মাষ্টার মশাইর ছাত্র-ছাত্রীর পড়া আদায় করা হাতের বেতের মতো নয়। মাষ্টার মশাইর হাতের বেতের মতোই লম্বা কাটাযুক্ত হলেও একটু ব্যবধান আছে, নামে বুনো বেত গাছ বলে এখানকার লোকে।

অপূরণীয় অভাব কষ্টের মাঝে থেকেও শিলার মুখ খানা দেখে সমস্ত ভুলে যায় মনু। দু’জনের সংসারে সুখ-দুঃখ দ’ুটোই আছে পাশাপাশি। একদিন সন্ধ্যা রাতে শিলা স্বামীর কোলে মাথায় রেখে সোহাগ মাখা কন্ঠে বলে, ‘শিলার গর্ভে নাকি মনুর সন্তান এসেছে’।
কথাটি শুনে মনুর আনন্দের কমতি নাই। পরক্ষনে আবার জিজ্ঞাসা করল, ‘কে বলেছে শিলার গর্ভে সন্তানের আগমন ঘটেছে’।
শিলা বলে দিলো, কে আবার চাচিমায়’।
মনু হঠাৎ আনন্দের পাশে চিন্তায় পড়ে গেলো। কিছু সময় নিশ্চুপ থাকল। অগ্রীম চিন্তা- দু’জনের সংসারে মাঝে মধ্যে উনুনে হাড়ি উঠে না। আবার আগমন নবজাতক সন্তান ! না যানি নবজাতককে পৃথিবীতে এসে কত কষ্ট পেতে হয়। শিলা এক বাক্যে বলে দিলো, ‘যহন গুরাগারা আইবে তহন চিন্তা করি, অহন ঘুমাও’।
-‘হু ঘুমামু’। 
মনু ঘুমের ঘরে রাত্রিকালে ধনী পাড়ার স্বপ্ন দেখে, সাঝেঁর বেলা স্বপ্ন রাখাল পাড়ার মাটি হয়ে যায়। রাতে মনু যখন স্বপ্নে বড়লোকের আশ্বাস পায়, শিলা তখন অনাগত শিশু কোলে নিয়ে আদর করে। সকাল বেলা শিলার আদর ছিড়া কাঁথা আর তুলা বের হওয়া বালিশে পায়।
-------------*********--------------

No comments

Powered by Blogger.