খালেদা নিন্দিত হলেন, নাকি সহানুভূতি পেলেন?

খালেদা নিন্দিত হলেন, নাকি সহানুভূতি পেলেন?

কাজী সাঈদ ॥
দেশের রাজনীতির মাঠে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। প্রথমত হচ্ছে বিএনপি দলটি ভেঙ্গে যাবে কিনা? এর জবাবে অনেকে বলছেন এরশাদের জাতীয় পার্টির মতো হবে, সময়ের ব্যাপার মাত্র। আমি তা মনে করছি না। কারণ জাতীয় পার্টি বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলো। যার ফলে দলে ভাঙ্গন সৃষ্টি হয়েছে। অনেক নেতা-কর্মীরা দল ছেড়ে অন্য দলে গিয়েছিলো। তাদের ধারনা ছিলো স্বৈরাচারের অভিযোগে বিদায় নেওয়া দলটির ফের ক্ষমতায় আসতে দেরি হবে। কিন্তু বিএনপি আন্দোলন সংগ্রাম করছে দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য। দলটির নেতা-কর্মীরা দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাহিরে। তাই ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে, করবে।

আমার দৃষ্টিতে দলটির নেতা-কর্মীরা আরো সুসংগঠিত হবে। সাংগঠনিক দুর্বলতা কেটে যাবে। দীর্ঘ আন্দোলনে শক্তিক্ষয়ী দলটির নেতা-কর্মীরা ঐক্যবদ্ধ হবে। দলটির অনেক নেতা-কর্মী দলীয় কোন্দোলের কারণে নিস্কিয় ছিলো। তারপরও সরকার বা সরকারি দলের জুলুম নির্যাতন থেকে রক্ষা পায়নি। দলীয় কোন্দোলে নিস্কিয় থাকা নেতা-কর্মীদের খালেদা জিয়ার সাথে কোন প্রুপিং নাই, কোন্দোল নাই। যে গ্রুপের অনুসারী হউক না কেন সকলের নেত্রী খালেদা জিয়া, সকল গ্রুপেরই প্রধান নেতা বেগম জিয়া-বিষয়টি মনে রাখতে হবে। দলের চেয়ারপারসন তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পাঁচ বছরের সাজা হয়েছে। দলীয় নেত্রীকে কারামুক্ত করতে হলে আইনী লড়াইয়ের পাশাপাশি আন্দোলন-সংগ্রাম করতে হবে, তা তারা বিশ্বাস করে। এক্ষেত্রে বিএনপির নেতা-কর্মীদের সুসংহত হওয়া ছাড়া বিকল্প আর কোন রাস্তা নাই তা নেতা-কর্মীদের অজানা নয়। “রাত যত গভীর হয়, প্রভাত তত নিকট আসে” এ ধারনা বিশাল কর্মীবাহিনীর মনে জন্ম নিয়েছে। সংসদের বাহিরে থাকা দলটির রয়েছে বিশাল তারুণ্যশক্তি। সর্বপরি দলের নেতা-কর্মীরা সুসংগঠিত হচ্ছে বলে আমি বিশ্বাস করি।
এবার আসি শিরোনামের বিষয়ে। জিয়া অরফানেজ ট্রাষ্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়া নিন্দিত হলেন, নাকি সহানুভূতি পেলেন? এই প্রশ্ন করলে একদল উত্তর দেয় নিন্দিত হয়েছেন। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন ও তাদের মিত্রদের সমর্থকরা। আবার একদল বলেছেন সহানুভূতি পেয়েছেন। আওয়ামী লীগ বিরোধী ও বিএনপি সমর্থক গোষ্টি। পক্ষে বিপক্ষে যুক্তি ও তর্ক-বিতর্ক চলছে। তবে দেশের শতকরা কত শতাংশ মানুষ এর পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে বা যুক্তি দেখাচ্ছে। তা অনুমান করতে অবশ্যই জরিপের প্রয়োজন আছে। তবে দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে নিরপেক্ষ জরিপ করাটাও মুশকিল।
আমার ধারনা বিএনপি নেত্রী অবশ্যই জনসাধারণের সহানুভূতি পেয়েছেন। ভোটের রাজনীতিতে খালেদা জিয়া ব্যাপক সহানুভূতি পেয়েছেন, পাবেন। এতটুকু বুঝতে বা অনুমান করতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র কিংবা রাজনৈতিক বিশ্লেষক হতে হবে না। শুধুমাত্র বাঙালী জাতির চারিত্রিক বৈশিষ্টের দিকে খেয়াল করলেই উত্তর সহজ। বাঙালীর জাতির মধ্যে সবসময় আবেগ শব্দটি বেশি কাজ করে। খালেদা জিয়ার বয়সের বিবেচনায় সাজার বিষয়টি সাধারণ মানুষ ভালভাবে নেয়নি। কারাগারে প্রথম শ্রেণির নাগরিকের সমস্ত সুযোগ সুবিধাও তাকে দেওয়া হয়নি। দীর্ঘদিন আন্দোলন-সংগ্রামে ক্লান্ত এবং সরকারের দমন নিপীড়ন ও নির্যাতনের মাত্রা অতিতের যেকোন সরকারের চেয়ে বেড়েছে। টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকায় ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা অনেকটা মারমুখি ভঙ্গিতে রয়েছে। এটা যতটা না দলের জন্য, তার চেয়ে বেশি নিজের ব্যক্তি স্বার্থে। যতটা না দেশের জন্য, তার চেয়ে বেশি দলের স্বার্থে। 
Kazi Sayed picture


খালেদা জিয়াকে কারাগারে নেয়ার পর থেকে বিএনপির নেতা-কর্মীদের ওপর ছাত্রলীগ-যুবলীগসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হামলা-মামলা, দমন নিপীড়ন সরকারি দলের বিপক্ষে গেছে। এমনকি বিএনপির শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ মিছিল-সমাবেশে পুলিশের বাধা, ধরপাকড় সাধারণ মানুষ মানতেই নারাজ। জনগণ ধরেই নিয়েছে এটা নিছক রাজনীতির মারপ্যাচ। বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে ঘায়েল করতে এবং নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে এটা সরকারের কারসাজি এমন ধারনা জনগণের মাঝে সৃষ্টি হয়েছে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বার বার বলার চেষ্টা করা হচ্ছে, রায়ে সরকারের কোন হাত নেই, দুর্নীতির সাজা মাত্র। কিন্তু জনগণ যে তা গ্রহণ করেনি তার প্রমাণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে লক্ষ্য করা যায়।

এদিকে সরকার বা সরকারি দল শত চেষ্টা করেও খালেদা জিয়ার দুর্নীতি বিষয়টি প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও তাঁর পুত্র তারেক রহমান দুর্নীতিবাজ তা দেশের অর্ধেক মানুষ বিশ্বাস করছে না। আর অর্ধেক মানুষের মধ্যে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। বিষয়টি সরকারি দলের এমপি-মন্ত্রীরা যতই জনগনকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু জণগন তা খাচ্ছে না। উল্টো বিএনপির নেতাদের বক্তব্য গ্রহণ করছে। এর বড় কারণ হিসেবে, শেয়ারবাজার, হলমার্ক, সোনালী ব্যাংক, ফামার্স ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, জনতা ব্যাংকসহ সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটের বিচার হচ্ছে না। যেখানে হাজার হাজার কোটি টাকার লুটপাটকারীদের ধরা হচ্ছে না, বিচার হচ্ছে না, সেখানে দুই কোটি দশ লাখ টাকার বিচার জনগণ মানবে কেন? তারপর অর্থমন্ত্রীর কয়েকটি বক্তব্য-চার হাজার কোটি কোন টাকাই না, মেগা প্রজেক্ট নেওয়া হয় সাগর চুরির জন্য ইত্যাদী মানুষ ভুলতে পারছে না। আবার বেগম জিয়ার মামলার বিচার ব্যবস্থা নিয়েও জনমনে প্রশ্ন রয়েছে। রায় প্রকাশের আগেই সরকারের মন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গার বক্তব্য, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত পতিত স্বৈরাচার এরশাদের বক্তব্যে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নিজেও একাধিকবার বলছেন এতিমদের টাকা মেরে খাচ্ছেন। দীর্ঘ দশবছর চলা মামলাটির রায় দশদিনে লেখা নিয়েও প্রশ্ন ওঠছে। 

অপরদিকে দেশের মানুষের একটি অংশ বিএনপির নেত্রীর অন্ধভক্ত, কিছু অংশ বিএনপি সমর্থক। তারা কোন ভাবেই বেগম জিয়ার সাজা মানতে পারছে না। উদাহরণস্বরূপ বলছি, বাংলাদেশ ক্রিকেট দল মাঠে খেলছে। দেশের মাঠে অথবা দেশের বাহিরে। সবাই চায় বাংলাদেশ দল জিতুক। দলটি মহা বিপর্যয়ে পরলেও ক্রিকেট ভক্তরা শেষ বলটি পর্যন্ত আত্মবিশ্বাস রাখে। এক বলে ছয় রান দরকার ক্রিজে মোস্তাফিজ অথবা অন্যকোন বোলার ব্যাট করছে, তখনও ভক্তরা জেতার স্বপ্ন দেখে। দেখাটাই স্বাভাবিক। খেলা দেখার সময় আমিও দেখি। কিন্তু অবাক করার বিষয় হচ্ছে, এক বলে যখন ছয় রানের বেশি রান লাগে তখনও জেতার স্বপ্ন দেখে। প্রতিপক্ষের বোলাররা বাই রান দিবে অথবা নো বল দিবে, ফ্রি হিট পাবে। কিন্তু কিছুই হলো না দল হারলো। আফসোস করে নিজেকে নিজে সান্তনা দেয়। এটাকে আত্মবিশ্বাস বলি আর অন্ধভক্ত বলি। এটাই বাস্তবতা। বিএনপির মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা ইতোমধ্যে সে আত্মবিশ্বাস অর্জন করেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ভয়কে বিএনপির কর্মীরা জয় দেখতে শুরু করেছে।

আমার দৃষ্টিতে বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার মতো ভোটব্যাংক ছিলো বা আছে। বাড়তি যোগ হয়েছে বেগম জিয়ার প্রতি মানুষের সহানুভূতি। এখন দেখার বিষয় তাঁর দল তাঁকে কারগার থেকে মুক্ত করতে পারে কিনা। বিএনপি নীতি নির্ধারকরা ক্ষমতাসীনদের কুট-কৌশল মোকাবেলা করতে কতটা সক্ষম হয়? দলটি সুসংগঠিত করে আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে নিরপেক্ষ সরকারের অধিনে একটি অবাধ, সুষ্ঠ নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাধ্য করতে পারে কিনা। তারেক রহমানের নেতৃত্বে দল কতটা সাফল্য অর্জন করতে পারে? দেখতে হলে আমাদের আগামী কয়েকটি মাস অপেক্ষা করতে হচ্ছে। # # #

লেখক: বার্তা সম্পাদক, অনলাইন সাগরকন্যা।

No comments

Powered by Blogger.